গল্প: বাবা
লেখক: মুশফিকুর রহমান
রিতু মা কাল কি ইন্টারভিউ দিতে যাবি?-হ্যাঁ বাবা। কাল ইন্টারভিউ দিতে যাবো। তুমি ঘুমাও তো বাবা।
ক'দিন ধরেই বাবার গায়ে খুব জ্বর। শুকনো কাশিটা ও বাড়তি। সারাদিন চেঁচামেচি করেছি ডাক্তারের কাছে যেতে। কিন্তু এমনি ঠিক হয়ে যাবে বলে বিছানায় পড়ে আছে। আমার বাবা একজন রিক্সাচালক। মা নেই। মা দেখতে কেমন সেটা ও মনে নেই! তাছাড়া মায়ের অভাবটা কখনোই বুঝতে দেয়নি বাবা। কথায় আছেনা বাবার পৃথিবী হচ্ছে মেয়ে। ঠিক তেমনি ভাবে ছোট থেকে খুব আদর স্নেহে বড় করেছেন।
যখন ছোট ছিলাম তখন বাবা আমাকে রিক্সা চালিয়ে স্কুলে দিয়ে আসতো। কখনো তপ্ত রোদে কখনো অঝোর বৃষ্টি উপেক্ষা করে আমাকে স্কুলে নিতো। বাবার কষ্ট দেখে আমার নিজের ও কষ্ট হতো খুব।
আমি যখন ক্লাস ফোরে পড়ি। একদিন বাবা আমাকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যেই বৃষ্টি নামলো। আমি বাবাকে বললাম," বাবা থামাও রিক্সা!"
-কেন রে মা!
বৃষ্টি হচ্ছে খুব। তুমি ভিতরে আমার পাশে বসো।
- তোর স্কুলের দেরী হয়ে যাবে। তুই বসে থাক।
বাবা তোমার জ্বর আসবে। তুমি ভেতরে আসো।
-এইতো চলে এসেছি মা।
বাবা সেদিন আমার কথা শোনেনি। বৃষ্টিতে ভিজেই ভিজেই আমাকে নিয়ে আসলো। রিক্সা থেকে নেমে বললাম," আচ্ছা বাবা, যখন তোমার রিক্সায় অন্য মানুষ ওঠে! তখন কি ওরা তোমাকে রিক্সা থামিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে নিষেধ করে?"
বাবা মৃদু হেসে এড়িয়ে বললো," যা যা স্কুলে দেরী হয়ে যাচ্ছে"।
সেই ছোট্ট বয়সেই বুঝেছিলাম বাবা আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছিলো। সেই দিন খুব রাগ করে লক্ষ্য ধরেছিলাম জীবনে কিছু একটা হবো।
সেই রাগ ধরেই আজ আমি মাস্টার্স পাশ করা একজন। কাল একটা বড় কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিতে যাবো। আমি আশাবাদী যে চাকরিটা হয়ে যাবে। আর চাকরীটা হলেই বাবাকে ভালো ডাক্তার দেখাবো। রিক্সাটা ও আর চালাতে দিবোনা। মনে মনে খুব খুশি। আজ এতো বছর পর হয়তো বাবার রক্ত পানি করা শ্রমের প্রতিদান দিচ্ছে আল্লাহ। খুশিতে বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে রিতু। মনে মনে বাবার জন্য এটা করবো ওটা করবো এইসব ফন্দী আঁটছে। ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়লো রিতু।
সকালে বাবা ঢেকে দিলো। গোসল সেরে ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। এমা এদিকে দেখছি বাবা ও প্রস্তুত হয়েছে রিক্সা নিয়ে বের হবার জন্য। আমি জোর গলায় বললাম," বাবা!"
-কি রে মা!
"তুমি কি আজ ও রিক্সা নিয়ে বের হবে?"
- তোর গন্তব্যস্থলে তোকে দিয়েই চলে আসবো।
" বাবা তোমার রিতু এখন ছোট নেই। এখন তোমার রিতু বড় হয়েছে। আজ থেকে তোমার রিক্সা চালানো বন্ধ।"
- কি বলিস! রিক্সা না চালালে খাবো কি?
" এখন থেকে তোমার সব দায়িত্ব আমার। তুমি শুধু ঘরে বসে বসে খাবা।"
- তুই আগে একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে কর। এইসব চাকরির আশা বাদ দে। তোর বিয়ে হলেই আমি একটু নিশ্চিন্ত হতে পারবো।
"তুমি আবার ও শুরু করেছো তো বিয়ে নিয়ে। যাও ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকো।"
বাবাকে ধরে ঘরে শোয়ার রুমে এনে পায়ে সালাম করলাম। বাবা মাথায় হাত ঘষে দিয়ে গুনগুন করে কি যেনো বললো। জানি বাবা দোয়া করে দিয়েছে।
বেরিয়ে পড়লাম ইন্টারভিউ দিতে। যথাসময়ে গিয়ে উপস্থিত হলাম। একটু পরেই আমাকে ডাকা হবে। একটু নার্ভাস লাগছে। কিছুটা নিজেকে নিজেই সাহস যোগানোর চেষ্টা করলাম। ভিতর থেকে আমার ডাক পড়লো। ভয়ে ভয়ে ভিতরে গেলাম। আমার সার্টিফিকেট গুলো তুলে দিলাম তাদের হাতে। অনুবীক্ষণ যন্ত্রের মতো সার্টিফিকেটগুলো খতিয়ে দেখলো। কয়েকটা প্রশ্ন উত্তর শেষে আমাকে আসতে বললো। আর বললো যদি সিলেক্টেড হই তখন আমার ফোনে নাকি মেসেজ আসবে।
মনটা ভারী হয়ে গেছে। মলিন মুখ নিয়ে হাঁটছে রিতু। এত স্বপ্ন এত আশা যে নিমিষেই যে গুড়িয়ে যাবে রিতু ভাবতেই পারেনি। বড্ড বড় মুখ নিয়ে এসেছিলো চাকরিটা হবে। কিন্তু ওনাদের কথায় মনে হচ্ছে চাকরিটা হবেনা। বাবার দায়িত্বটা নেওয়া বুঝি আর হবেনা। রিতুর এই ভেবে কষ্ট হচ্ছে যে, বাবার জন্য কিছু করতে পারলোনা। বিয়ে করলে তো বাবাকে ছেড়ে অন্যের ঘরে চলে যাবে। এই বুড়ো বয়সে বাবা একা একা কীভাবে থাকবে! রিতুর চোখ থেকে বিন্দু বিন্দু জল গড়িয়ে মাটিতে পড়ছে। সারাজীবনের শ্রম এখন রিতুর বৃথা মনে হচ্ছে।
বাড়ির সামনে আসতেই বাবা খক খক কাশির শব্দ শুনে রিতুর আর ভালো লাগছেনা। ঘরে ঢুকেই রিতু বললো," চলো বাবা ডাক্তার দেখাতে যাবো"!
আমাকে দেখে বাবা বললো, " কিরে চাকরী হইছে"?
আমি চুপ ছিলাম। বাবা আমার মুখ দেখেই বুঝে নিলো। বাবা বললো, " আমি ও মনে মনে তাই ভেবেছি যাতে চাকরিটা যেনো না হয়।"
আজ ও বাবা আমাকে কতটা সাপোর্ট দেয় তা বুঝতে আমার দেরী হলো না। বাবা বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলাম। বাপ বেটির অভিমান শেষে রিতু বললো," চলো বাবা ডাক্তারের কাছে যাবো"!
- কাল যোবো। আজ দেখি যদি এমনি এমনি সেরে যায়, তাহলে খামোখা আর ডাক্তারকে টাকা দিতে হবেনা।
বাবার এমন কথা শুনে আমি চুপ হয়ে গেলাম। বাবাকে কিছু বলে বুঝানোর মতো আমার কাছে নেই। বাবা বরাবরই নিজের বেলায় অযত্নশীল। কিন্তু আমার বেলায় বাবার ছিটে ফোঁটা যত্নের ও এুটি খুজে পাওয়া যায়না। বাবার ওমন কথায় বাইরে এসে বাবার রিক্সার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ধূলোবালি পড়ে আছে অনেক রিক্সায়। একটা ময়লা ত্যানা এনে রিক্সা মুচছিলাম। হঠাৎ ভিতর থেকে বাবা বললো," রিতুর মেসেজ এসেছে"।
ঘরে গিয়ে মেসেজ দেখে আমার চোর চোখ কপালে উঠে যায়। এক চিৎকারে বলি," বাবা আমার চাকরি হয়েছে"। খুশির সেই চিৎকারে বাবা ও আমার সাথে তাল দিলো আমার মেয়ের চাকরি হয়েছে। বাবার খুশি দেখে বললাম," বাবা তুমি না চাকরিটা যাতে না হয় মনে মনে চেয়েছিলে? তাহলে এখন কেন খুশি এতো?"
বাবার চোখটা ছলছল করছে জলে। ঠিক তক্ষুণি বাবে জড়িয়ে ধরে বললাম ভালোবাসি বাবা।