গল্পঃ গাফেলিয়াত
লেখিকাঃ মেহজাবিন মুন
"ইশ্ আজ যদি মানুষটা আমার পাশে থাকতো, কত কি শেয়ার করতাম!"
"ইশ্ মানুষটা আমাকে ছেড়ে চলে গেলো, বিনা অপরাধে ডিভোর্স দিয়ে দিলো। এত অল্পবয়সে ডিভোর্সি! তাও বিনা অপরাধে! আর এ জন্য মানুষ আমাকে নিয়ে কত কি বলাবলি করছে, হাসাহাসি করছে।" (কিছু দুঃখী বোনদের ভাবনা)
ডিভোর্স, পারিবারিক অশান্তি কিংবা অনেক আপুর স্বামী অল্প বয়সেই মারা যান। তখন আপুরা সেই ট্রেস নিতে পারেন না। তখন সাময়িক উদ্ভ্রান্ত হয়ে যান কারও কোন কথা শুনতে পারেন না, মন খারাপ করে বসে থাকেন, কিংবা কান্না করেন। রাত জেগে জেগে সেই মানুষটার স্মৃতিচারণ করেন আর চোখের নিচে কালি ধরান।
অনেকসময় হয়কি, পাশের বোন কিংবা ভাবীটি সাজগোছ করছে, তখন উনাকেও সাজের কথা বললো, তখন মনে পড়ে যায় আপনজনের কথা। আমি সেজে কি করবো? কাকে দেখাবো? কেউ কি আছে আমার?কারও সুখ দেখলেও কষ্ট লাগে ইশ্ আমারও তো এমন একটা সংসার হতো! কিংবা আমরা নিত্যদিনকার জীবনে অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলি, যেটাকে আমাদের কাছে অতীব প্রয়োজন মনে হয়। মনে হয় এটা না থাকলে বাঁচবো না।
অনেকসময় আমাদের শেয়ারিং কেয়ারিং, চাওয়া পাওয়ার একটা কেন্দ্রবিন্দু সেই মানুষটাকে ঘিরে রচিত হয়। হুট করে সেই মানুষটা চলে গেলে তখন আমাদের জীবনের শুরু হয় কান্না, বেদনা আর হতাশার আনাগোনা। আমরা তখন দ্বীন থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরে যাই।
মনে হয়,"আমি তো কোন অপরাধ করলাম না তারপরও আমার জীবনে এমন হলো? এত এত নামাজ পড়ে কি লাভ? বেঁচে থেকে কি লাভ? শুরু হয় আল্লাহর সাথে শয়তানের ধোঁকায় পড়া নিজের নাফসের আকাশ পাতাল দূরত্ব! আর তখন অনেকে আবেগের কারণে আত্মহত্যার পথ বেঁচে নেয়।(আল্লাহ মাফ করুন)
একবারও কি ভাবি? তখন আমার এই নিথর দেহ পড়ে রবে, হবে পোস্টমর্টেম। আর তা নাহলেও সকল মানুষের একরাশ ঘৃণার সাথে হবে আমার দাফন। আমি সেদিন মানুষ হয়েও তাদের কাছে সম্মান পাব না। সেদিনও সেই মানুষটা এসে জিজ্ঞেস করবে না "এখন কেমন আছো!" কিংবা তখন কি সেই হারিয়ে যাওয়া জিনিস পেয়ে যাবো?"
ভাই বোনেরা, এটা ছেলেমেয়ে সকলের ক্ষেত্রে ঘটে। আচ্ছা, মরে গিয়ে তো দুনিয়াবি দুঃখ থেকে বেঁচে গেলেন, এখন আখিরাতের অনন্ত শাস্তি থেকে কে বাঁচাবে?
আরে তাকিয়ে দেখুন চারপাশ, একটা সন্তান মারা গেলে তখন মা-বাবাও হয়ত চারপাঁচদিন কান্নাকাটি তারপর সব কিছু আগের মতই চলবে। আমার আপনার খবর আর কেউ রাখবেনা।
আমিহীন দুনিয়া ভালভাবেই চলবে। সূর্য
নিয়মিত উঠবে, নিয়মিত অস্ত যাবে শুধু আমার
আর ঘুম থেকে জেগে উঠা হবে না। আর ভুলগুলো শোধরানোর সুযোগ হয়ে উঠবে না।
এই দুনিয়াটা এমন যে, আজ আমি যে জায়গায় বসে আছি, সেটাও ও কয়েকঘন্টা পর অন্য কারও দখলে চলে যাবে। হুমম, সেই মানুষগুলোও তেমনি নতুন কাউকে মনে স্থান দিয়ে তাদের মতো করে বেঁচে থাকবে।
হে আমার ভাই-বোন, মৃত্যু কিংবা হতাশাই আপনার জীবনের সবকিছু নয়।
এই দুনিয়া তো ক্ষণস্থায়ী, আজ নিজের জীবনের সবকিছু বিস্বাদ মনে হচ্ছে। অন্যের মজা আর মাস্তিকে রঙিন মনে হচ্ছে, কিন্তু এই রঙিন
পৃথিবী ও সেদিন সবাইকে বিদায় জানাতে
দ্বিধাবোধ করবে না।
অনেকে আছে মনে প্রচন্ড মানসিক যন্ত্রনা হচ্ছে, তখন সেটাকে ভুলতে গান বাজনায় ডুবে যায়। দুঃখের গানগুলো শুনে শুনে চোখের লোনাজল ঝরায়। বিশ্বাস করুন এই অশ্রুর এক ফোঁটাও মূল্য নেই, না দুনিয়ায় না আখিরাতে।
দুনিয়ার গান বাজনা, ঝাকঝমক এসব তো শুধুই মরিচিকা আর চোরাবালি। মরিচিকার পেছনে ছোটেও যেমন দিনশেষে হতাশা ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়না, খাদের কিনারায় পা ফসকালে যেমন তলিয়ে যেতে হয় অতল গহবরে। এই দুনিয়া ঠিক তেমনি। পা ফসকালেই আপনি আল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্ন। আর এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করার মালিক একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহর উপর ভরসা ছাড়া সুখ কোথায় পাওয়া যায়?
তাই বলব, রবের দিকে ফিরে আসুন। এটাই
একমাত্র পথ যে পথ আপনাকে অনন্তকালের মুক্তির দরজা খুলে দিবে। যেই অনন্ত কাল আপনাকে একাই পাড়ি দিতে হবে।
বিলাল ফিলিপস বলেছেন, "এমন স্থানে সুখ খুঁজতে যাবেন না, যেখানে তা পাওয়া অসম্ভব। সুখ কেবল আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে, এবং এটাই,স্থায়ী হয়।"
দেখতে দেখতেই দুনিয়ার সময়টা চলে যাবে, শুরু হবে অনন্তর যাত্রা। এই অনন্তর যাত্রার পাতেয় আছে কিনা সেদিকে ফোকাস করুন বোন।
কারণ দুনিয়ার এই ক্ষনস্থায়ী চাওয়াগুলো পাওয়া হবে না বলেই আল্লাহ্ জান্নাত বানিয়ে রেখেছেন। পরকালই আমাদের ইচ্ছাপূরণের জায়গা বোন।
তারপরও আপনি আল্লাহর কাছে চাইতে পারেন। বিশ্বাস করুন, আপনি ছোট থেকে ছোট জিনিসও আল্লাহর কাছে চাইতে পারেন যেটা শুনলে মানুষ হাসাহাসি করবে। কিন্তু আমার আপনার রব্ব তা করেন না। আপনি যখনই হাতাশায় আক্রান্ত হবেন তখনই আরও নিবিড়ভাবে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করুন, সেজদায় লুটিয়ে পড়ে ধর্না দেন আল্লাহর কাছে। আল্লাহর সান্নিধ্যে বিলীন হয়ে যান,
একবার বলুন, "ইয়া আল্লাহ আপনার ভান্ডারে তো কোনকিছুর অভাব নেই, তাহলে আমি কেন আপনার রহমত থেকে নিরাশ হবো!"
বিশ্বাস করুন এতে যে কত সুখ, কত প্রশান্তি যে একবার ডুবে যেতে পেরেছে সেই জানে। তিনি তো শুধু "কুন-ফায়াকুন" বলবেন আর চোখের সামনে আপনার এমন চাওয়া পূরণ হবে আপনি বুঝতেই পারবেন না। আমরা কি আল্লাহর উপর অভিমান না করে আবদার করতে পারিনা? গাফেলিয়াতে না ডুবে রহমতে ডুবে যেতে পারিনা? অনেক আমলদার ভাই বোনও দ্বীন থেকে গাফেল হয়ে যান শুধু না পাওয়া আর হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে। আচ্ছা আপনি কিভাবে বুঝলেন আপনি আজ যা চাইছেন কিংবা হারিয়েছেন সেটা আপনার জন্য কল্যানকর আর জরুরি ছিলো? আমরা যদি এসব জানতাম তাহলে আমরা নিজেরাই নিজেদের ফিউচার লিখে ফেলতাম। আল্লাহর রাব্বুল আলামিন বলেছেন, "আমি যা জানি তোমরা তা জানো না।"
আল্লাহর হুকুম মানুন, যেটা হয়ে গেছে সেটা আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়ামত ভেবে পরের পাওয়াগুলোর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করুন। হতে পারে আপনি যা ডিজার্ভ করেন, আল্লাহর আপনার জন্য যে উত্তম জিনিস রেখেছেন আপনি এখনও সেটার যোগ্য হয়ে উঠেননি। তাই এখন শুধু প্রস্তুতি নিন আর সময়ের অপেক্ষা করুন।
মন খারাপ হলে একবার আকাশের দিকে তাকান, ভাবুন এই আকাশ যদি এত বিশাল হয় তাহলে আকাশের মালিকের দয়া কতটা বিশাল হতে পারে! অন্তর প্রশান্ত হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ! এই তো দর্শন, এই তো জীবন, এই তো দুনিয়া, এই তো কারাগার। আর মুু'মিনের জন্য দুনিয়া হল সত্যিই কারাগার।
একবার ভাবুন, "সেই বিশাল আকাশের মালিকের কাছে কিইবা চাইতে পারি আমি?" তিনি যতটুকু দিতে পারেন, ততটুকু চাওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। কেবল তিনিই দান করেন বিশ্বজগতের প্রতিপালক যা ইচ্ছা করেন। আর দিতে তো পারেন তিনিই।
মানুষের জীবনে হাজারো কষ্ট থাকে বোন। স্বপ্নভঙ্গের কষ্ট, অপূর্ণতার কষ্ট। ইট দালানের ঘরে মখমলে শোয়ে থাকা মানুষটার ভিতরেও কষ্ট আছে, আছে না পাওয়ার যন্ত্রণা, সেও বিছানায় শোয়ে না পাওয়ার কষ্টের নিঃশ্বাস ছাড়ে। এই কষ্টগুলো বাকিরা দেখে না। কিন্তু একজন দেখেন, একজন জানেন, তিনি শুনতে পান আমাদের হৃদয়ের প্রতিটা রক্তক্ষরণ, মনসাগরে উতালপাতাল হাজারো ঢেউকে রবের সান্নিধ্যে আচড়ে পড়তে দিন। কষ্টের সেই সময়গুলোয় হাসিমুখে স্রষ্টার দাসত্ব করে যাওয়া-এই তো সবর।
মনে করুন, বিশ্বজগতের শাহানশাহের কাছে আমার জীবন-সম্পদ সব বিক্রি করে দিয়েছি শুধু তাঁর সন্তুষ্টির আশায়। নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করি আমরা কিন্তু রবের সন্তুষ্টি থেকে দূরে সরে যাই, নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে তাঁর থেকে সুখের লেনাদেনায় মেতে উঠি। কিন্তু রাব্বে করিমের নির্ধারণ করে দেওয়া দাম মেটাতে চাইনা, আমরা এমনি কৃপণ! আমরা শুধুই পারি পাওয়া দ্রব্যের ওপর নিজের অনধিকারটুকু প্রতিষ্টা করতে। তবু আমাদের রব্ব আমাদের শাস্তি দেন না। তিনি অবিরাম সুযোগ দিয়েছেন, দিয়ে যাচ্ছেন, আর অপেক্ষা করছেন দিনশেষে নীড়ে ফেরার। তাই হে প্রিয়! আল্লাহর কাছে উত্তম হয়ে যান।
সূরা আর রহমানে আল্লাহ্ মুত্তাকীদের পুরষ্কারের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন- "উত্তমের বিনিময় উত্তম ছাড়া আর কী হতে পারে?" এই আয়াতটি যখন অনুভব করি চোখ দুটো ভিজে ওঠে, অন্তর আর্দ্র হয়ে যায়।
বোন আমার! আমরা যখন শুধু আল্লাহর জন্য একটা ছোট্ট কষ্ট স্বীকার করব, ফিরে আসবো প্রশান্তির মালিকের কাছে সকল চাওয়া পাওয়া নিয়ে। আর আল্লাহ্ সেটাকে লক্ষগুণে বাড়িয়ে প্রতিদান দেবেন না, তাই কি হয়? আল্লাহর প্রতিদান তো এমনই হয় যা তাঁর মর্যাদার জন্য উপযোগী। মানুষ আপনাকে ক্ষুদ্র বলছে, খুত ধরছে, আর একটা বাহানা দেখিয়ে আপনাকে ফেলে চলে যাচ্ছে। আর আপনিও নিজেকে ক্ষুদ্র ভাবছেন, এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছেন দুনিয়া আর দুনিয়ার মালিকের থেকে। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন "আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সুন্দরতম আকৃতিতে। তিনি তো বান্দার ক্ষুদ্রতার দিকে, দূর্বলতার দিকে দিকে তাকান না বোন, বরং নিজের বড়ত্বের দিকে তাকিয়ে পুরস্কার দেন। অল্প বিনিময় দেওয়া যে তাঁর শানের খেলাফ!
সেদিন যদি আমার চাওয়া পাওয়া দেখে হাসতে পারি, সবাইকে দেখিয়ে দিতে পারি আমার রবের কাছে আমি ক্ষুদ্র ছিলাম না! ক্ষুদ্রতা তো তাঁর মনেই ছিলো যে চলে গেছে। তখন আমিই তো সফল হয়ে গেলাম। তুচ্ছ দুনিয়ার চাওয়াপাওয়ার হিসেব দিয়ে আমার কী আসে যায়?
তাই গাফেলিয়াত নয় বোন, ফিরে আসুন আল্লাহর পথে। তৈরি করুন নতুন করে আল্লাহর পথে ফিরে আসার গল্প, যে গল্পে হাজারো চাওয়া পাওয়া আর হতাশার মৃত্যু হয়ে যায়। কিন্তু আবারও আকাশ থেকে এক পশলা আল্লাহর রহমতের বৃষ্টি হবে। আবারও সবুজ ফুলফসলে ছেয়ে যাবে আপনার উষর-মরু আঙ্গিনা।
- মেহজাবিন মুন
লেখিকাঃ মেহজাবিন মুন
"ইশ্ আজ যদি মানুষটা আমার পাশে থাকতো, কত কি শেয়ার করতাম!"
"ইশ্ মানুষটা আমাকে ছেড়ে চলে গেলো, বিনা অপরাধে ডিভোর্স দিয়ে দিলো। এত অল্পবয়সে ডিভোর্সি! তাও বিনা অপরাধে! আর এ জন্য মানুষ আমাকে নিয়ে কত কি বলাবলি করছে, হাসাহাসি করছে।" (কিছু দুঃখী বোনদের ভাবনা)
ডিভোর্স, পারিবারিক অশান্তি কিংবা অনেক আপুর স্বামী অল্প বয়সেই মারা যান। তখন আপুরা সেই ট্রেস নিতে পারেন না। তখন সাময়িক উদ্ভ্রান্ত হয়ে যান কারও কোন কথা শুনতে পারেন না, মন খারাপ করে বসে থাকেন, কিংবা কান্না করেন। রাত জেগে জেগে সেই মানুষটার স্মৃতিচারণ করেন আর চোখের নিচে কালি ধরান।
অনেকসময় হয়কি, পাশের বোন কিংবা ভাবীটি সাজগোছ করছে, তখন উনাকেও সাজের কথা বললো, তখন মনে পড়ে যায় আপনজনের কথা। আমি সেজে কি করবো? কাকে দেখাবো? কেউ কি আছে আমার?কারও সুখ দেখলেও কষ্ট লাগে ইশ্ আমারও তো এমন একটা সংসার হতো! কিংবা আমরা নিত্যদিনকার জীবনে অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলি, যেটাকে আমাদের কাছে অতীব প্রয়োজন মনে হয়। মনে হয় এটা না থাকলে বাঁচবো না।
অনেকসময় আমাদের শেয়ারিং কেয়ারিং, চাওয়া পাওয়ার একটা কেন্দ্রবিন্দু সেই মানুষটাকে ঘিরে রচিত হয়। হুট করে সেই মানুষটা চলে গেলে তখন আমাদের জীবনের শুরু হয় কান্না, বেদনা আর হতাশার আনাগোনা। আমরা তখন দ্বীন থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরে যাই।
মনে হয়,"আমি তো কোন অপরাধ করলাম না তারপরও আমার জীবনে এমন হলো? এত এত নামাজ পড়ে কি লাভ? বেঁচে থেকে কি লাভ? শুরু হয় আল্লাহর সাথে শয়তানের ধোঁকায় পড়া নিজের নাফসের আকাশ পাতাল দূরত্ব! আর তখন অনেকে আবেগের কারণে আত্মহত্যার পথ বেঁচে নেয়।(আল্লাহ মাফ করুন)
একবারও কি ভাবি? তখন আমার এই নিথর দেহ পড়ে রবে, হবে পোস্টমর্টেম। আর তা নাহলেও সকল মানুষের একরাশ ঘৃণার সাথে হবে আমার দাফন। আমি সেদিন মানুষ হয়েও তাদের কাছে সম্মান পাব না। সেদিনও সেই মানুষটা এসে জিজ্ঞেস করবে না "এখন কেমন আছো!" কিংবা তখন কি সেই হারিয়ে যাওয়া জিনিস পেয়ে যাবো?"
ভাই বোনেরা, এটা ছেলেমেয়ে সকলের ক্ষেত্রে ঘটে। আচ্ছা, মরে গিয়ে তো দুনিয়াবি দুঃখ থেকে বেঁচে গেলেন, এখন আখিরাতের অনন্ত শাস্তি থেকে কে বাঁচাবে?
আরে তাকিয়ে দেখুন চারপাশ, একটা সন্তান মারা গেলে তখন মা-বাবাও হয়ত চারপাঁচদিন কান্নাকাটি তারপর সব কিছু আগের মতই চলবে। আমার আপনার খবর আর কেউ রাখবেনা।
আমিহীন দুনিয়া ভালভাবেই চলবে। সূর্য
নিয়মিত উঠবে, নিয়মিত অস্ত যাবে শুধু আমার
আর ঘুম থেকে জেগে উঠা হবে না। আর ভুলগুলো শোধরানোর সুযোগ হয়ে উঠবে না।
এই দুনিয়াটা এমন যে, আজ আমি যে জায়গায় বসে আছি, সেটাও ও কয়েকঘন্টা পর অন্য কারও দখলে চলে যাবে। হুমম, সেই মানুষগুলোও তেমনি নতুন কাউকে মনে স্থান দিয়ে তাদের মতো করে বেঁচে থাকবে।
হে আমার ভাই-বোন, মৃত্যু কিংবা হতাশাই আপনার জীবনের সবকিছু নয়।
এই দুনিয়া তো ক্ষণস্থায়ী, আজ নিজের জীবনের সবকিছু বিস্বাদ মনে হচ্ছে। অন্যের মজা আর মাস্তিকে রঙিন মনে হচ্ছে, কিন্তু এই রঙিন
পৃথিবী ও সেদিন সবাইকে বিদায় জানাতে
দ্বিধাবোধ করবে না।
অনেকে আছে মনে প্রচন্ড মানসিক যন্ত্রনা হচ্ছে, তখন সেটাকে ভুলতে গান বাজনায় ডুবে যায়। দুঃখের গানগুলো শুনে শুনে চোখের লোনাজল ঝরায়। বিশ্বাস করুন এই অশ্রুর এক ফোঁটাও মূল্য নেই, না দুনিয়ায় না আখিরাতে।
দুনিয়ার গান বাজনা, ঝাকঝমক এসব তো শুধুই মরিচিকা আর চোরাবালি। মরিচিকার পেছনে ছোটেও যেমন দিনশেষে হতাশা ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়না, খাদের কিনারায় পা ফসকালে যেমন তলিয়ে যেতে হয় অতল গহবরে। এই দুনিয়া ঠিক তেমনি। পা ফসকালেই আপনি আল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্ন। আর এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করার মালিক একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহর উপর ভরসা ছাড়া সুখ কোথায় পাওয়া যায়?
তাই বলব, রবের দিকে ফিরে আসুন। এটাই
একমাত্র পথ যে পথ আপনাকে অনন্তকালের মুক্তির দরজা খুলে দিবে। যেই অনন্ত কাল আপনাকে একাই পাড়ি দিতে হবে।
বিলাল ফিলিপস বলেছেন, "এমন স্থানে সুখ খুঁজতে যাবেন না, যেখানে তা পাওয়া অসম্ভব। সুখ কেবল আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে, এবং এটাই,স্থায়ী হয়।"
দেখতে দেখতেই দুনিয়ার সময়টা চলে যাবে, শুরু হবে অনন্তর যাত্রা। এই অনন্তর যাত্রার পাতেয় আছে কিনা সেদিকে ফোকাস করুন বোন।
কারণ দুনিয়ার এই ক্ষনস্থায়ী চাওয়াগুলো পাওয়া হবে না বলেই আল্লাহ্ জান্নাত বানিয়ে রেখেছেন। পরকালই আমাদের ইচ্ছাপূরণের জায়গা বোন।
তারপরও আপনি আল্লাহর কাছে চাইতে পারেন। বিশ্বাস করুন, আপনি ছোট থেকে ছোট জিনিসও আল্লাহর কাছে চাইতে পারেন যেটা শুনলে মানুষ হাসাহাসি করবে। কিন্তু আমার আপনার রব্ব তা করেন না। আপনি যখনই হাতাশায় আক্রান্ত হবেন তখনই আরও নিবিড়ভাবে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করুন, সেজদায় লুটিয়ে পড়ে ধর্না দেন আল্লাহর কাছে। আল্লাহর সান্নিধ্যে বিলীন হয়ে যান,
একবার বলুন, "ইয়া আল্লাহ আপনার ভান্ডারে তো কোনকিছুর অভাব নেই, তাহলে আমি কেন আপনার রহমত থেকে নিরাশ হবো!"
বিশ্বাস করুন এতে যে কত সুখ, কত প্রশান্তি যে একবার ডুবে যেতে পেরেছে সেই জানে। তিনি তো শুধু "কুন-ফায়াকুন" বলবেন আর চোখের সামনে আপনার এমন চাওয়া পূরণ হবে আপনি বুঝতেই পারবেন না। আমরা কি আল্লাহর উপর অভিমান না করে আবদার করতে পারিনা? গাফেলিয়াতে না ডুবে রহমতে ডুবে যেতে পারিনা? অনেক আমলদার ভাই বোনও দ্বীন থেকে গাফেল হয়ে যান শুধু না পাওয়া আর হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে। আচ্ছা আপনি কিভাবে বুঝলেন আপনি আজ যা চাইছেন কিংবা হারিয়েছেন সেটা আপনার জন্য কল্যানকর আর জরুরি ছিলো? আমরা যদি এসব জানতাম তাহলে আমরা নিজেরাই নিজেদের ফিউচার লিখে ফেলতাম। আল্লাহর রাব্বুল আলামিন বলেছেন, "আমি যা জানি তোমরা তা জানো না।"
আল্লাহর হুকুম মানুন, যেটা হয়ে গেছে সেটা আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়ামত ভেবে পরের পাওয়াগুলোর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করুন। হতে পারে আপনি যা ডিজার্ভ করেন, আল্লাহর আপনার জন্য যে উত্তম জিনিস রেখেছেন আপনি এখনও সেটার যোগ্য হয়ে উঠেননি। তাই এখন শুধু প্রস্তুতি নিন আর সময়ের অপেক্ষা করুন।
মন খারাপ হলে একবার আকাশের দিকে তাকান, ভাবুন এই আকাশ যদি এত বিশাল হয় তাহলে আকাশের মালিকের দয়া কতটা বিশাল হতে পারে! অন্তর প্রশান্ত হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ! এই তো দর্শন, এই তো জীবন, এই তো দুনিয়া, এই তো কারাগার। আর মুু'মিনের জন্য দুনিয়া হল সত্যিই কারাগার।
একবার ভাবুন, "সেই বিশাল আকাশের মালিকের কাছে কিইবা চাইতে পারি আমি?" তিনি যতটুকু দিতে পারেন, ততটুকু চাওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। কেবল তিনিই দান করেন বিশ্বজগতের প্রতিপালক যা ইচ্ছা করেন। আর দিতে তো পারেন তিনিই।
মানুষের জীবনে হাজারো কষ্ট থাকে বোন। স্বপ্নভঙ্গের কষ্ট, অপূর্ণতার কষ্ট। ইট দালানের ঘরে মখমলে শোয়ে থাকা মানুষটার ভিতরেও কষ্ট আছে, আছে না পাওয়ার যন্ত্রণা, সেও বিছানায় শোয়ে না পাওয়ার কষ্টের নিঃশ্বাস ছাড়ে। এই কষ্টগুলো বাকিরা দেখে না। কিন্তু একজন দেখেন, একজন জানেন, তিনি শুনতে পান আমাদের হৃদয়ের প্রতিটা রক্তক্ষরণ, মনসাগরে উতালপাতাল হাজারো ঢেউকে রবের সান্নিধ্যে আচড়ে পড়তে দিন। কষ্টের সেই সময়গুলোয় হাসিমুখে স্রষ্টার দাসত্ব করে যাওয়া-এই তো সবর।
মনে করুন, বিশ্বজগতের শাহানশাহের কাছে আমার জীবন-সম্পদ সব বিক্রি করে দিয়েছি শুধু তাঁর সন্তুষ্টির আশায়। নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করি আমরা কিন্তু রবের সন্তুষ্টি থেকে দূরে সরে যাই, নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে তাঁর থেকে সুখের লেনাদেনায় মেতে উঠি। কিন্তু রাব্বে করিমের নির্ধারণ করে দেওয়া দাম মেটাতে চাইনা, আমরা এমনি কৃপণ! আমরা শুধুই পারি পাওয়া দ্রব্যের ওপর নিজের অনধিকারটুকু প্রতিষ্টা করতে। তবু আমাদের রব্ব আমাদের শাস্তি দেন না। তিনি অবিরাম সুযোগ দিয়েছেন, দিয়ে যাচ্ছেন, আর অপেক্ষা করছেন দিনশেষে নীড়ে ফেরার। তাই হে প্রিয়! আল্লাহর কাছে উত্তম হয়ে যান।
সূরা আর রহমানে আল্লাহ্ মুত্তাকীদের পুরষ্কারের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন- "উত্তমের বিনিময় উত্তম ছাড়া আর কী হতে পারে?" এই আয়াতটি যখন অনুভব করি চোখ দুটো ভিজে ওঠে, অন্তর আর্দ্র হয়ে যায়।
বোন আমার! আমরা যখন শুধু আল্লাহর জন্য একটা ছোট্ট কষ্ট স্বীকার করব, ফিরে আসবো প্রশান্তির মালিকের কাছে সকল চাওয়া পাওয়া নিয়ে। আর আল্লাহ্ সেটাকে লক্ষগুণে বাড়িয়ে প্রতিদান দেবেন না, তাই কি হয়? আল্লাহর প্রতিদান তো এমনই হয় যা তাঁর মর্যাদার জন্য উপযোগী। মানুষ আপনাকে ক্ষুদ্র বলছে, খুত ধরছে, আর একটা বাহানা দেখিয়ে আপনাকে ফেলে চলে যাচ্ছে। আর আপনিও নিজেকে ক্ষুদ্র ভাবছেন, এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছেন দুনিয়া আর দুনিয়ার মালিকের থেকে। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন "আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সুন্দরতম আকৃতিতে। তিনি তো বান্দার ক্ষুদ্রতার দিকে, দূর্বলতার দিকে দিকে তাকান না বোন, বরং নিজের বড়ত্বের দিকে তাকিয়ে পুরস্কার দেন। অল্প বিনিময় দেওয়া যে তাঁর শানের খেলাফ!
সেদিন যদি আমার চাওয়া পাওয়া দেখে হাসতে পারি, সবাইকে দেখিয়ে দিতে পারি আমার রবের কাছে আমি ক্ষুদ্র ছিলাম না! ক্ষুদ্রতা তো তাঁর মনেই ছিলো যে চলে গেছে। তখন আমিই তো সফল হয়ে গেলাম। তুচ্ছ দুনিয়ার চাওয়াপাওয়ার হিসেব দিয়ে আমার কী আসে যায়?
তাই গাফেলিয়াত নয় বোন, ফিরে আসুন আল্লাহর পথে। তৈরি করুন নতুন করে আল্লাহর পথে ফিরে আসার গল্প, যে গল্পে হাজারো চাওয়া পাওয়া আর হতাশার মৃত্যু হয়ে যায়। কিন্তু আবারও আকাশ থেকে এক পশলা আল্লাহর রহমতের বৃষ্টি হবে। আবারও সবুজ ফুলফসলে ছেয়ে যাবে আপনার উষর-মরু আঙ্গিনা।
- মেহজাবিন মুন
❤❤সমাপ্ত❤❤