মনপূরা
- আবির হাসান নিলয়
"আবির সাহেব, আমি জানি আজকে আপনার অকস্মাৎ উন্মদনা আমার মাাঝে বিলিনতার এক বিশেষায়ণ করবেন। আপনাকে বাধা দেওয়ার।অহেতুক প্রচেষ্টাও যাবে মিশ্রহীন ক্ষুন্নতার বহিঃপ্রকাশ। আচ্ছা, চাইলে কি উন্মাদনা এক চিলতে কালো মেঘের ন্যায় প্রবহমান বাতাসের বিষাদে উড়িয়ে দিলে কেমন হয়? বাধা দেবো না, কেবল আপনার মন গভীরে আমার প্রতি প্রবণতার তীব্রতা কমানোর সামান্য প্রচেষ্টা মাত্র। কেননা, আমি যে অন্যের মায়ায় আবদ্ধ। আমি যে ভালোবাসি একজনকে।"
উচ্ছাসময় এক ব্যস্ত পরিসরের সমাপ্তিতে পৌছে যখন লাল কেশর ন্যায় পান্জাবি পরে, ফুলঘেরা চির পরিচিত ঘরে প্রবেশ করলাম। তখনো যেন সব নিরব নিস্তব্ধ আর এক সামান্য অচেনা হয়েছিল জিরো লাইটের আলোয় ঘেরা পরিচিত রুমটা। বিছানার মাঝ গভীরে সম্মোহিত প্রতাবর্তন নারী লাল গোলাপের গালিচা বেষ্টিত বিছানায় বসে ফু্ঁপিয়ে কাঁদছে। আমি ধীর পায়ে হেঁটে গেলাম বিছানার কাছে।
মেয়েটির নাম অবনি। অবনি শব্দটি অবনী শব্দের বিশেষ্য পদ। যার মানে হল পৃথিবী, দেশ বা ভূমি। অবনির সাথে যখন প্রথম কথা হয় ওদের বাড়ির নীলকণ্ঠ ফুল গাছ ঘেরা ব্যালকণির এক কোণাতে। সে চুপ ছিল। আমিও চুপ থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম পায়ে হাঁটা রাস্তার উপর এক বাচ্চা খালি গায়ে কাঁদছে। কিন্তু বাচ্চাটির চোখে পানি নেই। কিছু মানুষ আছে, নিজের মনে আর মস্তিষ্কে কষ্টের বিশাল মরুভুমি বানিয়ে ফেললেও, চিৎকার করে কাঁদতে পারে না। কেউ নিরবে চোখের নোনা জল ঝরায় আবার কেউ কেবল কাঁদতেই জানে কিন্তু চোখ দিয়ে জল বের হয় না। নিরব হয়ে থাকার এক বিশাল অতপ্রকৃতি আছে। সেই প্রকৃতির সৃষ্টিকর্তা আপনি। অবনি প্রশ্ন করে.. "আবির সাহেব, চুপ থাকবেন?" আমি মুচকি হেসে ওকে বোকার মত প্রশ্ন করি "আপনার নাম, অবনি। অবনি শব্দের অর্থ কী জানেন?" অবনি কিছুই বলেনি। কিঞ্চিৎ হাসি দিয়ে সে ব্যালকণি থেকে চলে যায়।
"কেমন আছেন অবনি?" শুনেছি বাসর রাত নিয়ে প্রতিটা মানুষের আলাদা আর ভিন্নরকম স্বপ্ন থাকে। সেই স্বপ্নের ভাগিদ্বার হয় তার প্রিয় মানুষ। কিন্তু কয়জনই বা প্রিয় মানুষের হাত ধরে কিংবা কাধে মাথা রেখে ফুলসজ্জার রাত পার করে? মেয়েরা হয় একদিক দিয়ে অবহেলিত। ছোট থেকে নিজের পছন্দমত সব হলেও, জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন বস্তুটা হল শরীরের অংশ মানে বরটাকে পছন্দ করতে দেয় না। সেইটাই পছন্দ করে দেয় পরিবার। অবনিকে প্রশ্ন করে কথাগুলো ভাবছিলাম। কিন্তু সে উত্তর না দিয়ে একদম উপরের কথাগুলো বলে।
আমি নিস্তব্ধ এক অপরিহার্য বিদেশী নতুবা দুরদেশী মুসাফির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। অবনি নামক ছায়াটা যেন সূর্যের ভালোবাসার টানে একটু একটুু করে আমার উন্মাদনার করিডোর থেকে দুরে সরে যাচ্ছে। সে আমার দিকে চেয়ে আছে। তার চোখের নিশ্চুপ চাহনি বলছে "আবির সাহেব, কিছু তো বলেন।" আমি মুচকি হেসে বললাম..
"আচ্ছা, আপনার মনের শহরে আমি জলাশয়ের ন্যায় বদ্ধ বা আবদ্ধ হবো না।"
"সত্যিই হবেন না?"
"নাহ, সব ভালোবাসা হয় পূর্ণতায়। কিন্তু মজার ব্যাপার হল সব পূর্ণতা যে মুগ্ধকর হবে এমন না।"
"আবির সাহেব, আপনি মানুষটা কিন্তু অনেক ভালো।"
আমি মুচকি হাসলাম। এই হাসির একটি বিশালতার মত কারণ আছে। মানুষ কখনো অকারনে হাসে না। মানুষ তিনটে কারনে হাসে। প্রথম কারন, জোকস বা মজার কথা বললে হাসে। তারপর, অন্য কেউ নিজের ব্যাপারে সত্যতা বের করে বলে, ধরা পড়ার পর হাসে। আরেকটা হল, কোনো প্রশ্নের যুতসই জবাব না দেওয়ার কারনে হাসে। আপাতত আমি মজার কথা শুনেই হাসলাম। অবনি বললো..
"আপনি হাসছেন যে?"
"না এমনি। ছেলেটার নাম কি?"
"তার নাম রিফাত। ভালোবাসি থাকে খুব। কথা ছিল সে আমাকে তার করে নেবে। সময়ও চেয়েছিল। বোকার মত বলেছিলাম 'আমি তোমার জন্য সবসময় অপেক্ষা করবো। কিন্তু.."
"হিহিহি.. কিন্তু এমনটা হয়নি। মানুষ কেনো প্রেমে পড়ে জানেন? মনের চাহিদা পূরণের জন্য। মনের চাহিদা হল ভালোলাগার ভোগবিলাশ মাত্র। সবাই বলে ভালোবাসায় বিষাদ, বেদনা আছে। তবুও মানুষ প্রেমে পড়ে। হুমায়ূন স্যারের একটা কথা আছে 'প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় প্রেম বলে কিছু নেই। মানুষ যখনি,যতবার প্রেমে পড়ে সেটাই তার প্রথম প্রেম।' কথাটার গভীরতা বিশাল।"
"আপনি কিন্তু অনেক গুছিয়ে কথা বলেন। আচ্ছা রাগ হচ্ছে না আমার উপর? নতুন বিয়ে করা বউ, বাসর ঘরে বলছে, সে অন্য কাউকে ভালোবাসে। অন্য কেউ হলে ঠিকই বউকে ডিভোর্সের প্রস্তুতি নিত। আপনি কেনো চুপ আছেন?"
অবনির কথায় কোনো উত্তর দিলাম না। অবনিকে চিনতাম না আমি। মায়ের কথায় অবনিকে দেখি। অবনির বাবা আর আমার পরিবার চেয়েছে আমাদের চার হাত এক করতে। খুব যেন তাড়াতাড়িই বিয়ে হয়ে গেলো অবনির সাথে আমার। বিয়ের আগেও সে আমাকে কিছু বলেনি। কিন্তু সেদিন ওর মন খারাপের মুখটা আমাকে যেন মনে করিয়ে দিচ্ছিল কালো মেঘের শহরে আমার যেতে হবে, যেন ছন্দহীন কালো মেঘের ভেলা আমার শহরেই উড়ে আসছে। বেদনার নীলচে নয়, সাদা বৃষ্টি ঝরাবে।
আমি গা থেকে পান্জাবি খুলে নিলাম। নীল কালোছায়া আকাশী রং এর টিশার্ট পরে ব্যালকণিতে এসে বসলাম। দরজা আটকে দিয়ে আকাশ দেখছি। খুব সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। যদিও আমি সিগারেট খাইনা। কিন্তু শুনেছি সিগারেটের সাদা ধোয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে ছেঁড়ে দিলে এক শৈলপিক আনন্দ পাওয়া যায়। আমার কি তবে সিগারেট খাওয়া উচিৎ? না, ধুমপান কখনো ভালো কিছু বয়ে আনে না।
সাবিহা মেয়েটার হাসি মুখ খুব মনে পড়ছে। মেয়েটাকে যে আমি পছন্দ করতাম, এটা কখনো বুঝিনি আমি। বোঝার আগেই যে বিয়ে হয়ে যায় সাবিহার। দুজনে একি জায়গাতে জব করতাম। প্রতিদিন চোখাচোখি হতো। প্রেম শুরু হওয়ার প্রথম ও প্রধান মাধ্যম হল তাকানো। বিয়ে বাড়ি কিংবা ক্লাস রুম সবখানে তাকিয়ে থাকার মাধ্যমে প্রেম আলাপন শুরু হয়। আমিও তাকাতাম।
কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে সাবিহা বাসন্তি রং এর শাঁড়ি পরে এসেছিল আমার সামনে। আমি ওকে ডেকে বলেছিলাম "আমার না শাঁড়ি পছন্দ না।" সে একটু শুকনো দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল আমার দিকে। সবার পছন্দ এক না। প্রায় সব ছেলেদের শাড়ি আর নারী একসাথে পছন্দ। আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বেশ আলাদা। আমার থ্রি পিচ বা সালোয়ার কামিজেই মেয়েদেরকে বেশি আকর্ষনীয় লাগে। যদিও ঠিকভাবে তাকানো হয়না মেয়েদের দিকে। সাবিহা বলে
"অনেক কষ্টে তোমার জন্য শাঁড়ি পরে এসেছি। আমি না শাঁড়ি পরতে পারি না।"
"আমার জন্য?"
"না মানে.. হুম তোমার জন্য। ভেবেছিলাম তোমার ভালো লাগবে।"
আমি একটু হেসেছিলাম। সেদিন ছিল পহেলা বৈশাখ। আমি ওকে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে ডেকে এনেছিলাম। গ্রীষ্মের খরতাপ। মাথার ওপর গনগনে সূর্য। মিরপুর বোটাবিনক্যাল গার্ডেনের প্রধান ফটক থেকে অফিস ভবন পর্যন্ত যেতেই ঘেমে-নেয়ে একাকার। গিয়েছিলাম ট্যাবেব্যুইয়া ফুলের খোঁজে। সেখানে ট্যাবেব্যুইয়ার উৎসব দেখে অবাকই হলাম। অনেকগুলো গাছ, তাতে বর্ণিল পুষ্প প্রাচুর্য একেবারেই ধারণাতীত। অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা তার শ্যামলী নিসর্গ গ্রন্থে ঢাকায় যে দু-একটি ট্যাবেব্যুইয়ার সন্ধান দিয়েছিলেন, তা এখন অতীত। ভেবেছিলাম ঢাকায় এ প্রজাতি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু না, বোটানিক্যাল গার্ডেন গাছটিকে সংরক্ষণ করে নিশ্চিত বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করেছে।
বোটানিক্যাল গার্ডেনে ট্যাবেব্যুইয়ার সন্ধানে গিয়ে দেখা পেলাম গর্জনেরও। প্রবেশ পথের দ্বিতীয় ফটক পার হতেই ডানপাশে কয়েকটি গাছ চোখে পড়ে। গাছতলায় পড়ে থাকা রাশি রাশি ঝরাফুল দেখে গাছের আদ্যোপান্ত খুঁটিয়ে দেখি। সরল কান্ডের সুউচ্চ গাছ, একেবারই খাড়া, ফুলও বেশ ওপরে। ঘুরতে ঘুরতে মধুগন্ধি কইনার ফুলেরও দেখা পেলাম।
সেখান থেকে কয়েকটি ফুল নিলাম। হাঁটতে হাঁটতে সাবিহার সাথে এসে দাঁড়ায় কৃষ্ণ গাঁছের নিচে। মুখে ঘাম জমে সাবিহাকে সরল সুহাসিনি লাগছে। আমি রুমাল এগিয়ে দিলাম। সাবিহা মুখ মুছে বলে..
"আবির, আজকে তোমাকে একটি কথা বলতে চাই, শুনবে?"
"হুম শুনবো। বলো।" সাবিহা কিছুু সময় চুপ থেকে তারপর বলে "আবির, তোমাকে আমার বেশ পছন্দ হয়। কখনো তোমার আজীবনের সঙ্গি হওয়ার আহ্বানে চাই, আমাকে কি ফিরিয়ে দেবে?" সাবিহার দিকে তাকিয়ে কিছুই বলিনি। রিকশা নিয়ে ওর বাড়ির সামনে চলে আসি। সারাটা পথ চুপই ছিলাম। যখন সে রিকশা থেকে নেমে দাঁড়ায়। আমার দিকে উত্তর শোনার দৃষ্টিতে তাকায়। আমি শুকনো হাসি দিয়ে বলি "কালকে বলবো, তোমার আহ্বান আর আমার প্রবহমান মনের কথা।"
সাবিহা হেসে চলে যায়। সে হয়ত ধরে নিয়েছিল আমি হ্যা বলবো। বলবো সে যেন আমারই থাকে। হুম এটাই বলতে চেয়েছিলাম। পরেরদিন সাবিহাকে আমার কথাগুলো বলার জন্য অপেক্ষা করি। স্যার এসে বলে "তোমাদের কলিক, সাবিহা। তার গত কাল বিকালে বিয়ে হয়ে গেছে। হুট করে বিয়ে হয়েছে, তাই কাউকে কিছুই জানাতে পারেনি। সামনের সপ্তাহে অনুষ্ঠান। সবাইকে দাওয়াত করেছে।"
স্যারের কথা শুনে, একরাশ স্তব্ধতা আর নৈরাষিত কষ্টের বিষাক্তততা নিয়ে অফিস থেকে বের হয়েছিলাম। এরপর সেখানে আর যায়নি আমি। সাবিহার সাথে দেখা হয়নি আর বলাও হয়নি "হ্যা সাবিহা, তোমাকে আমার পাশে কোম্পানি রাখতে চাই।"
ব্যালকণি থেকে বের হলাম। সকাল হয়ে গেছে বেশ কিছু সময় হল। ব্যালকণির দরজা খুলে ঘরে আসলাম। অবনি বিছানায় বসে ফোনে কথা বলছে। ওর বলা কথাগুলো কান এড়ালো না। "রিফাত, চিন্তা করো না। আমি আসবো তোমার কাছে। তুমি খুব তাড়াতাাড়ি আমাকে নিতে আসো। আমিও যে তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না।" আমি রুম থেকে বের হলাম। আসলে কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারে না কথাটা ভুল। কথাটা হবে ' আমি তোমাকে ছাড়া ভালো থাকতে পারবো না।' কিন্তু আমরা সেটা বলিনা।
তিনদিন পর অফিস যাচ্ছি। অবনি জানালার কার্ণিশে গা এলিয়ে, গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওর পাশে যেয়ে দাঁড়ালাম। মাথাটা নিচু করে বললাম.. "কিছু মনে না করলে আমার গলার টাই টা একটু বেধে দিবেন? আসলে মা সবসময় বেঁধে দেয়। কিন্তু ওনার কড়া আদেশ, বউ তোর টাই বেঁধে দেবে।" অবনি একটু বিরক্তবোধ দৃষ্টিতে তাকালো। আমি চলে আসার প্রস্তুতি নিতেই সে টাই ধরে বললো
"একদম বাচ্চাদের মত আপনি। এত বোকা কেনো? নাকি এত ভালো আপনি? নিজের বউ তার প্রেমিকার সাথে ফোন আলাপ করে, এটা দেখেও কিছু বলেন না কেনো?"
"প্রতিটা মানুষের মনের খিদে থাকে। খিদেটা বিশাল। যা পূরণের জন্য খাবার নয় সঠিক সময়ের দরকার। আপনার হয়ত এটাই সঠিক সময়"
"আপনি বেশ আজব প্রকৃতির লোক।"
"হয়ত, তবে সেটা আমার নিজস্ব পৃথিবী। যে পৃথিবীতে শুধু নীল আকাশ আছে। কিন্তু আজকাল সেই নীল আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা পরিলক্ষিত।"
"আপনি, গুছিয়ে কথা বলেন।"
কিছু বললাম না আমি। অবনি জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ব্যাগ কাধে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলাম। কিছুই ভালো লাগছে না। শুনেছিলাম যে যেমন, তার কপালে তেমন বউ জোটে। আচ্ছা আমি কি তবে এমন কিছুই করেছিলাম? না হতো করিনি। তাহলে বাক্যটাই ভুল। গুরুচন্ডালি দোষ বাক্যে। তিক্ততা যেন আমাকে গ্রাস করছে।
অফিসে এসে বসলাম। কাজে মন বসাতে পারছি না। কোথায় যেন খাঁপছাড়া এক বিদ্ধস্ত অনুভুতি আমাকে ছন্নছাড়া করে দিচ্ছে। আজ আমি ছন্নছাড়া, তোমার অবহেলায় নয়ত তোমার না পাওয়াই। ফোন বেজে ওঠে। অবনির কল। রিসিভ করলাম।
"আবির সাহেব, আসার সময় একতোড়া লাল গোলাপ আনবেন। রিফাতের লাল গোলাপ বেশ পছন্দ। ভিডিও কলে তাকে দেখাবো।"
"আচ্ছা।"
ভালোবাসায় কষ্ট আছে জানতাম। কিন্তু বিশ্বাস করতাম না। কারন ভালোবাসা তো স্বর্গের রূপ। ভালোবাসা তো সৃষ্টিকর্তার নেয়ামত। তবে আজ বুঝলাম, মানুষ কেনো বলতো ভালোবাসায় কষ্ট থাকে। এখন বুঝতে পারছি, তারা কেনো বলেছিল। যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভোলে না মোরে। আমার তো পাখি নেই। আছে কেবল এক আকাশ ভালোবাসা মিশ্রিত সাদা মেঘ। কিন্তু শ্রাবণের হিংস্রতায় অধিকারযুক্ত কালো মেঘ এসে ভর করেছে আমার ছোট্ট চিলেকোঠায়।
অফিস শেষ হয়েছে। কি আজব ব্যাপার। আমি আমার ভালোবাসার জন্য তার কথা শুনছি। আর সে শুনছে অন্যের ভালোবাসার কথা। প্রতিটা সম্পর্ক দুটো কারনে নষ্ট হয়। একটা বিরক্তবোধ, আরেকটা হল তৃতীয় পক্ষ। এক তোড়া লাল গোলাপ নিলাম। গোলাপে পানি ছিটিয়ে দেওয়া। রিকশায় করে বাড়িতে এলাম। কলিংবেল বাজাতেই অবনি এসে দরজা খুলে দিল।
গোলাপগুলো ওর দিকে বাড়িয়ে দিলাম। সে মিষ্টি হাসলো। আর আমি হাসলাম শুকনো হাসি। ব্যাগ খুলে টেবিলে রাখার সময় অবনি বললো "রিফাত আসছে পরশু দিন আমাকে নিতে। আপনাকে আর জ্বালাবো না। জানেন, সে আমাকে কতটা ভালোবাসে। তাকে আপনার কথা বলেছি। সে বারবার বলেছে, এমন মানুষ কখনো হয় নাকি? সে না বিশ্বাসই করছে না।"
আমি একটু হাসলাম। দুনিয়ায় যারা ভালো মানুষ হিসেবে কাজ করে। তারা হয় মহান। আর যারা খারাপ কাজ করে তারা হয় শক্তিধর, ঐশর্যময়। আচ্ছা আমি কি মহান? না মহান তো সৃষ্টিকর্তা। মানুষ মহৎ হবে। আমি বললাম..
"কিছু মনে না করলে, পরশু দিন আমি কি আপনাকে রেখে আসতে পারি স্টেশনে?"
"আপনি যাবেন? নাহ থাক, যেতে হবে না। আপনার কষ্টটা বাড়াতে চাইনা।"
"অনুরোধটা রাখুন। প্রমিস আমি কেবল দুর থেকেই দেখবো আপনাদের। ঐ মানুষটাকে দেখার যে খুব ইচ্ছে।"
"কিন্তু বাসায় কি বলবেন?"
"বাড়িতে সবাইকে আমি বুঝিয়ে বলবো।"
"আপনি আসলেই অনেক ভালো। আমাকে ডিভোর্স লেটার পাঠাতে ভুলবেন না কিন্তু।"
"জ্বি আচ্ছা।"
"ধন্যবাদ, আপনার জন্য চা করে আনি।"
অবনি চলে যায়। আমি গা থেকে শার্ট খুলে নিরবে, নিভৃতে মনের আকুতি বিড়বিড় করে বলছি। টি শার্ট পরতেই অবনি চা এনে হাজির। চা হাতে নিতেই ওর ফোন বেজে উঠল। অবশ্যই রিফাতের ফোন। সে রিসিভ করে।
"রিফাত, আবির সাহেব ডিভোর্স দিতে রাজি হয়ে গেছে। মানুষটাকে যত দেখছি তত অবাক হচ্ছি। তুমি চিন্তা করো না। আমরা একসাথে আজীবন থাকবো। তোমাকে কখনো কষ্ট পেতো দেবো না।"
আহ, কি সাংঘাতিক কথা। আমার কষ্টগুলোকে কচু পাতায় ফেলে দিয়ে সে অন্যকে কষ্ট পেতে দেবে না জানালো। আচ্ছা অবনি কি একটুও বুঝতে পারছে না, আমি তাকে ভালোবেসে ফেলেছি। ওর আঁখিযুগল আর চিকন ঠোঁট আমাকে উদ্ভাসিত করে ভালোবাসার নদীতে খেয়া চলাচলের জন্য। যেখানে নৌকাটা হল আমি। আর দাঁড়টা হল অবনি। নাহ সে বুঝবে না এসব।
"আবির সাহেব, আমাকে শাঁড়ি কিনে দেবেন?"
পরেরদিন অফিসে যাওয়ার আগ মুহুর্তে অবনির মুখ থেকে কথাটা শুনলাম। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে "এই মেয়ে শোনো, আমার শাঁড়ি পছন্দ না।" কিন্তু মুচকি হেসে বললাম 'হুম দেবো।' পৃথিবীর সব মানুষ মাত্রই অভিনেতা। কেউ ভালোবাসা আদায় করতে অভিনয় করে। কেউ অভিনয় করে কষ্ট লুকানোর জন্য।
"চিন্তা নেই, রিফাত টাকা দিয়ে দেবে। আসলে সেই বলেছে আপনার থেকে কিনে নিতে। টাকা এসেই দেবে।"
"তার দরকার নেই। মনে করুন, আমার তরফ থেকে আপনাদের জন্য এটাই গিফট।"
"তাহলে চলুন না এখনি। আজ অফিসে না গেলে কি নয়? একদিনই তো জ্বালাচ্ছি।"
"আচ্ছা চলুন। যাবো না আজ অফিসে।"
অবনি খুশিতে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমি যেন স্ট্যাচু হয়ে যায়। এই প্রথম কোনো মেয়ের এতটা কাছে এসেছি। ওর শরীরের মাদকিয় গন্ধ আমাকে পরাজিত সৈণিকের মত ওর দিকে আত্বসমর্পন করে দিল। মনেন ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে লাগলো কোনো রোমান্টিক গান। সে নিজেই আমাকে ছেঁড়ে দিল। মানুষ নিজের থেকে অন্যের জন্য বেশি খুশি হয়। মা বলতো, নিজের বাড়ির থেকে পাশের বাড়ির তরকারী বেশি মজাদার হয়। কথা শুনে আমি হাসতাম। কিন্তু আমার সর্বাদ তরকারী বাছবিছার করে খাওয়ার অভ্যাসে মা বিরক্ত হতো।
অবনিকে শাড়ি কিনে দিলাম। নীল শাঁড়ি। বিষাদের রং। আচ্ছা নীল রং কে কেনো বিষাদের রং বলা হয়? আপনি কি হলুদ রঙের কক্ষে বসলে অস্থিরতা অনুভব করেন? কিংবা নীল রঙের কক্ষ কি আপনাকে কিছুটা স্বস্তি আর প্রশান্তি দেয়? বিষয়টা অবাক করার মতো হলেও মানুষের মনের ওপর রঙের অদ্ভুতরকম প্রভাব রয়েছে। কখনো কোনো রং আমাদের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে, আবার কখনো কোনো রঙের কারণেই হতাশার একটি ভাব আমাদের আচ্ছন্ন করে।
অবনি আমার হাত ধরে সারাটা পথ এসেছিল। আমি কিছুই বলিনি। জিজ্ঞাসা করার সাহসও হয়নি 'কেনো তুমি আমার হাত ধরেছো? তুমি তো অন্যতে পরজীবি।' অবনি আজ বেশ খুশি। ফোন নিয়ে বসেছে রিফাত সাহেবের সাথে কথা বলতে। আমি বিরক্ত করলাম না। ব্যালকনিতে এসে বসলাম ইজি চেয়ারে। আকাশ দেখছি। মনে মনে ভাবছি, আমার মনের আকাশে কি কখনো ভালোবাসা চিল উড়বে না? কি জানি?
"আবির, এই আবির ওঠো.. দেরি হয়ে যাচ্ছে। ওঠো না...."
আমি লাফ দিয়ে উঠলাম। ঘুম ঘুম চোখে সামনে তাকালাম। অবনি সুন্দর একটি থ্রি পিচ ড্রেস পরে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝলাম ওর গোছানো শেষ। আমি চোখ কঁচলে ওর মুখের দিকে তাকালাম। গাঢ় লিটিষ্টিক আর মেকাপে কেমন যেন লাগছে।
"রিফাত এসে গেছে। নয়টা বাজে, উফ এত সময় ধরে ঘুমান আপনি। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিন। আমাকে পৌছে দিবেন বলেছিলেন।"
অবনির হাত থেকে তোয়ালে নিলাম। চলে আসবো, একটু থেকে বললাম "হালকা করে লিপিষ্টিক দেন, আর চুৃলগুলো সামনে কিছুটে রেখে খোপা করেন। চোখে কাঁজল দিতে পারেন। আপনাকে দারুন মানাবে। ওহ সরি, শাঁড়ি পরবেন না আপনি?" অবনি একটু হেসে বললো.. "নাহ, থাক শাড়ি পরবো না। আপনি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিন। বাড়িতে বলেছি আমরা ঘুরতে যাচ্ছি। সব কিন্তু ম্যানেজ করবেন আপনি।"
কিছু না বলে ওয়াশরুমে গেলাম। খুন কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার। নিরব কান্না বারবার বলছে অবনিকে যেতে দিস না। কিন্তু আমি কি করবো? না পারছি থাকতে না পারছি নিষ্ঠুর হতে। আমি আটকালে তিনজন কষ্ট পাবে। আমি, অবনি আর রিফাত। না আটকাবো না। না হয় মহৎ হয়ে অবনিকে সাহায্য করি।
আব্বার গাড়িতে উঠলাম। অবনি ব্যাগপাক নিয়ে আগেই গাড়িতে যেয়ে বসে আছে। আমি একবার ওর দিকে তাকালাম। অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সাবিহার মত করে অবনিকেও কিছু বলা হবে না। গাড়ি চালানো শুরু করি। কিছু সময় পর রেল স্টেশনে এসে পৌছালাম। গাড়ি থেকে নেমে অবনির কাছে যেয়ে দাঁড়াতেই সে বললো..
"আপনি দাঁড়াবেন না এখানে। রিফাত আপনার সাথে দেখলে হয়ত রাগ করবে। বুঝতেই তো পারছেন সে একটা বিবাহিত মেয়েকে নিজের করতে যাচ্ছে।"
"ওহ, অবনি।"
"জ্বি, কিছু বলবেন?
"আসলে না মানে ওনাকে একটু দেখবো।"
"প্লিজ না, আপনি যান প্লিজ.."
আমি গাড়িতে যেয়ে বসলাম। অবিনকে বলতে চেয়েছিলাম "একবার কি ভেবে সিদ্ধান্ত নিলে হয়না? বলতে চেয়েছিলাম 'আমার থেকে দুরে না গেলেই নয়?" কিন্তু পারলাম না। গাড়ি ঘুরিয়ে স্টেশন রোড পেরিয়ে চলে এলাম পরিচিত চায়ের দোকানে। বন্ধুরা মিলে চা খেতে আসতাম এখানটাতে। কারন সামনেই তিন্নিদের বাসা। তিন্নিকে পছন্দ করতো আরাদ। ছাদ থেকে আরাদকে দেখতো তিন্নি। আর আরাদ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ইশারায় চা খাওয়ার অফার করতো। আরাদ তিন্নিকে নিয়ে একদিন পালিয়ে যায়।
বাসার সবাই কয়েকমাস পরে মেনে নিয়েছিল। কি সব নিয়ম। প্রেম করলে ছেলে হৃতিক রোশন হলেও পরিবার না করে দেবে। আবার পালিয়ে গেলে মেনেও নেবে। সচারচার আমি তেমন চা খাই না। কিন্তু আজ কখন যে আট কাপ চা খেয়ে ফেলেছি টেরই পাইনি। মামা বললো
"মামা, আটকাপ চা চলছে, এত কাপ তো খান না। আজ কি বেশি চিন্তিত? মানুষ চিন্তায় থাকলে অনেক কিছুই খেয়াল থাকে না।"
"যেমন?"
"যেমন, আপনি হাঁটছেন, সামনে গাড়ি খেয়াল নেই। আবার আপনাকে কেউ ডাকছে, কত কথা বলছে আপনি শুনতে পেলেও খেয়াল করতে পারবেন না। আমার বউ সকালে বলেছিল বাজার থেকে মাছ আনতে আমি চিন্তায় ছিলাম। মাছ না এনে চলে এসেছি।"
আমি চমকে উঠলাম। মামার কথা শুনে বুকটা ধুক করে উঠলো। সকালেই তো অবনি, আমাকে তুমি করে ডেকেছিল। তুমি করে কথাও বলেছিল। আমি খেয়ালই করিনি। সে কেনো আমাকে তুমি করে বলেছিল? সে তো সবসময় আপনি করে বলেছে। কেমন যেন আশাদৃত কিছু একটা খুজে পাচ্ছি। পকেট থেকে একশ টাকার নোট দিয়ে তাড়াতাড়ি গাড়িতে যেয়ে বসলাম।
একটানে রেল স্টেশনে এসে থামলাম। গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। কেনো জাানিনা মনে হচ্ছে অবনি এখনো যাায়নি। আমি চারপাশে খুজতে থাকি। কিন্তু অবনি নেই। আশা যেন কোথায় উড়ে গেলো। কেনো এলাম এখানে? মরিচীকা কেবল দুর থেকেই সুন্দর লাগে। কাছে গেলে সব ধোয়াশা। একজন লোককে জিজ্ঞাসা করলাম "ভাই ট্রেণ চলে গেছে?" লোকটা হুম বলে চলে যায়।
সব শেষ। অবনি চলে গেছে। আমি মনখারাপ করে পিছনে ঘুরলাম। একবার পিছনে তাকিয়ে মুচকি হেসে সামনে পা বাড়ালাম। ঠিক তখনি মনে হল, কে যেন দুরের যাত্রী ছাউনিতে বসে আছে। একি ড্রেস, একি রকম চুলের স্টাইল। আমি ঘুরে তাকালাম আমার। হ্যাঁ তাকে দেখা যাচ্ছে। আচ্ছা আমার চোখের ভূল নয়তো? রিফাত আসেনি। আমি বলবো অবনিকে আমার কাছে থাকতে। সে যদি চড়ও দেয়, তবুও বলবো। যেতে দেবো না আমি তাকে। বোঝাবো আমি তাকে ছাড়া আমার সবটাই অগোছালো।
আমি দৌড়ে আসলাম সেখানে। হা এটা আমার অবনি। আমার..? কখন সে আমার হল? ধুর এসব এক্সপ্লেইন করার সময় নেই। সে আমার অবনি মানে আমার। অবনির সামনে দাঁড়াতেই সে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আমি কিছু বলতে যাবো, তার আগেই সে আমার গালে আঁলতো করে চড় দিয়ে জড়িয়ে ধরল। কাঁদতে কাঁদতে বললো..
"গাধা একটা, কিচ্ছু বোঝে না। গাধাটাকে যে ভালোবাসি আমি একবারো জানতে চেয়েছে? জানতে চেয়েছো আমার কথা? মুখ ফুঁটে কেনো বলোনি আমাকে ভালোবাসো? কেনো নিরবে কেঁদেছো? একবারো বলোনি কেন "অবনি যেতে হে না, থাকো আমার কাছে।"
আমি বোকার মত দাঁড়িয়ে আছি। অবনি কাঁদতে কাঁদতে বলল "রিফাত নামের কেউ নেই। বান্ধবির সাথেই কথা বলতাম তোমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে। অজানা অচেনা একটা ছেলের সাথে আমাকে বিয়ে দেয়। মানুষটা কেমন তা যাচাই করার জন্যই এমন করি। আমাকে মাফ করে দাও। তোমাকে সঠিকভাবে চেনার জন্য এমন করেছি। ভালোবাসি আবির তোমাকে।"
আমি অবনিকে ছাঁড়িয়ে নিলাম। ওর হাত ধরে আস্তে গলায় বললাম "আমিও ভালোবাসি তোমাকে।" অবনি মুচকি হাসলো। ওর হাত। ধরে হাঁটার প্রস্তুতি নিচ্ছি। সে বললো 'ঐ গাধা, ব্যাগ গুলো কে নেবে?' ব্যাাগ আনতে যায়। সে এসে বলে "দুজনেই নেবো।"
অবনির সাথে হাটছি। আমার মনের শহরে কালো মেঘ সরে গেছে। পাখিরা যেন গান গাইছে। মনে হচ্ছে জীবনটা কতসুন্দর। আসলে জীবন সুন্দর হয় মানুষের যখন মনের চাহিদা পূরণ হয়।
(সমাপ্ত)