অভিমান মেহজাবিন মুুন |
--স্যার আমার মেয়েটাকে ভালোভাবে আদর স্নেহ দিয়ে রাখবেন। আমার টাকা লাগবে না স্যার।
-- না না বোন কি বলেন, এই দু’লক্ষ টাকা রাখেন আপনার পরিবারের কাজে লাগবে।
-- তাহলে একলাখ টাকা দিন স্যার।
--কেন বোন? পাশে থাকা মহিলা আম্মুকে প্রশ্ন করলেন।
-- না মানে কম টাকা নিলে তো আপনারা আমার মেয়েকে দেখতে দিবেন। তাই আরকি। একটু আমতা আমতা করেই আম্মু বললেন।
--- সমস্যা নেই বোন, আমরা যতদিন দেশে আছি যখন ইচ্ছা গিয়ে দেখবেন। আর ওকে তো এখন থেকেই আমার কলিজার টুকরো করে নিয়েছি। বলে মহিলাটি আমাকে অত্যন্ত আদরে বুকে জড়িয়ে নিলো।
আর আমি অভিমান করা গলায় বললাম,"আম্মু তুমি আমাকে বিক্রি করে দিয়েছো আমি আর তোমাকে আম্মু ডাকবো না।"
আম্মু তখন আমার সামনে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়েছিলো। তখন আমি আম্মুর মধ্যে যতটুকু অসহায়ত্ব দেখেছি আর কখনও কারও মধ্যে দেখিনি।
ওরা আমাকে নিয়ে আসার সময় পরম অভিমানে আম্মুর দিকে ফিরেও তাকাইনি।
আম্মুর পাশে দাঁড়িয়ে মাইশা আর মিনহা ও কাঁদছিলো। আমি ওদের সাথেও কথা বলিনি।
হ্যা আমি মুমু বলছি। আমাকে বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনা বলছি, তখন আমি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়তাম। তখন যতটুকু বুঝতাম মনে হয়েছিল আম্মু আমাকে বিক্রি করে দিয়েছেন। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি একজন মা কতটা অসহায় হলে তার সন্তানকে অন্যের হাতে তুলে দেন।
আজ আমার বয়স ২৫ বছর, আমি এখন পরিপূর্ণ একটা মেয়ে, একজন মা, একজন নারী, একজন আদর্শ স্ত্রী, একজন দক্ষ ডাক্তার। আর আমার স্বামী... সেও আমাকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। তাকে আমি আমার বাবার মত হতে দেইনি। ভালোবাসা দিয়ে ইসলামের চাদরে আবৃত রেখেছি সবসময়।
সে যখন প্রথম আমাকে দেখতে এসেছিল জিজ্ঞেস করেছিল, "আপনার প্রিয় শখ কি? আপনার চাওয়া গুলো বলুন তো?"
--- আমার স্বামী আমাকে অনেএএএক ভালোবাসবে।
--- এটা কেমন চাওয়া স্বামী তো বউকে ভালেবাসেই! সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো। আর আমি বলেছিলাম,
---তাহলে অনেকে বউকে ভুলে যায় কেন? একাধিক বিয়ে করে কেন? ঘরের বউয়ের সাথে বেইমানি করে কেন? পরকিয়ায় আসক্ত হয় কেন?
--- সেটা তো অনেক ক্ষেত্রে বউরাও হয়।
--- আমি সব বউ, সব স্বামীর কথা জানতে চাইনা। আমি আমার স্বামীকে আমার একান্ত আপন করে চাই।
কনে দেখতে এসে মেয়ের মুখ থেকে এরকম লজ্জাজনক কথা হয়তো আর কোন বর শুনেনি। সে কিছুক্ষণ আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিলো, "আমি এই বিয়েতে রাজি!"
আলহামদুলিল্লাহ! আমার প্রতি তার ভালোবাসা আমার কল্পনারও বাহিরে। এখনও সেদিনের কথা মনে পড়লে হাসি উঠে। পরে অবশ্য সে বলেছিলো, যে মেয়ে এমন কথা বলতে পারে সে না জানি তার স্বামীকে ভালোবাসতে পারে এটা ভেবেই আমাকে সে বিয়ে করেছে। আমি আমার জীবনের পরিপূর্ণতা পেয়েছি আমার পালক বাবা মায়ের হাত ধরে। যেদিন আমি বুকভরা অভিমান নিয়ে তাদের সাথে এই বিদেশ বিভুইয়ে পাড়ি জমিয়েছিলাম। আজ কেন জানি সব এলোমেলো মনে পড়ছে, একটা স্মৃতির সাথে আরেকটা বাধা পড়ে যাচ্ছে। আজ আমার এলোমেলো ভাবতে ভালো লাগছে, খুব খুব ভালো।
--- মামনি কখন বাংলাদেশ দেখা যাবে?
---এইতো মামনি একটু পরেই দেখা যাবে।
--- দূর তুমি পঁচা কিচ্ছু জানোনা। আব্বু বলো না বাংলাদেশ এখন কোথায় গেছে? আসেনা কেন প্লেনের নিচে!?
ওর কথায় মাহাদি হেসে ফেললো। আমার মেয়ে যতটুকু উতলা তার চেয়ে যে শতকোটিগুণ বেশি আমি উতলা হয়ে আছি দেশে ফেরার জন্য সেটা তাকে কে বুঝাবে। হ্যা আমি দেশে আসছি, আজ চৌদ্দ বছর পর আমার মাকে দেখার জন্য, তাকে জড়িয়ে ধরে অভিমান ভরা গলায় আম্মু ডাকার জন্য। বাঁধভাঙা খুশির জোয়ারে ভেসে যাওয়ার জন্য।
"আম্মু, আম্মুগো... আমি আসছি। তোমার মুমু তোমার কাছেই আসছি...!
মনে পড়ছে সেদিনের কথা যেদিন ফ্রান্স আসার জন্য পালক বাবা মায়ের হাত ধরে চলে আসছিলাম সেদিন দূর থেকে আম্মু বলেছিলেন, আমার মুমুকে আজ সাহেবের মেয়ে লাগছে, একবার আম্মু ডাক না মা!!
--- তুমি পঁচা, কত্তগুলা পঁচা! তুমি আমার আম্মু না। এখন এরাই আমার আব্বু আম্মু।
সেদিন রাগে অভিমানে মায়ের দিকে তাকাইনি। হয়তো তাকালে আর আসতে পারতাম না। কিন্তু ছোট্ট এই আমির ভিতরে জিদ ছিলো আব্বু তো ফ্রান্সেই আছে এসেই তাকে খুঁজে বের করে জিজ্ঞেস করবো আমার আম্মুকে রেখে উনি আরেকটা বিয়ে করলেন কেন। আমার ভাবনা ফ্রান্স আমাদের গ্রামের মতো একটা গ্রাম। সেখানে সবাইকে এক গ্রামেই দেখতে পাওয়া যায়!
সেদিন প্লেনে উঠার পর অনেক কেঁদেছিলাম আম্মুকে, বোনদেরকে ফেলে আসার জন্য। মনে হয়েছিল একদৌড়ে গিয়ে আম্মুকে 'আম্মু' বলে জড়িয়ে ধরি। আমার কান্না দেখে সেদিন পালক মা বলেছিলেন, "এইতো মা আমি তোমার আম্মু, আমি তোমাকে একটুও কষ্ট পেতে দেবো না।" বাবাও পরম মমতায় বুকে আগলে বলেছিলেন, "তোমার জন্য অনেক অনেক খেলনা, কাপড়, খাবার রেখেছি। আমরা একসাথে ঘুরবো আনন্দ করবো।"
--- আপুকে আর মিনহাকে আনা যায়না আমাদের সাথে? ওদের ছাড়া আমার ঘুম লাগেনা।
আবারও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিলাম আর ওরা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। কারণ জবাব যে জানা থাকলেও ওরা দিতে পারবে না।
আমি এত আদর, খাবার, আর নতুন নতুন জিনিস পেয়ে খুশি হয়ে গেলাম। কারণ আমার আম্মু কখনও ইচ্ছা থাকা সত্বেও আমাদের ভালো খাবার খাওয়াতে পারেনি। আমার দাদীর জন্য, আমার ফুপু আর আব্বুর জন্য। আমরা যখন নানুবাড়িতে যেতাম তখন অনেক আদর পেতাম। কিন্তু নানু মারা যাবার পর আম্মু একেবারে অসহায় হয়ে পড়লেন।
আমার আম্মু এমন একজন মানুষে যে বোধহয় ধৈর্য্যের মাত্রাও ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিদিন মাঝরাতে তাহাজ্জুদে আম্মুর কান্না শুনতাম। কখনও আম্মুর পাশে বসে কাঁদতাম। কেন কাঁদতাম জানিনা, আম্মুর কান্না দেখেই হয়তো। সন্তান আর মায়ের মধ্যে এমন এক সংযোগ তার দেওয়া আছে এটা কখনও ছিড়ে ফেলা যায়না। মায়ের কান্নায় সন্তান কেঁদে ফেলে আর সন্তানের সামান্য কষ্ট ও তো মা সহ্য করতে পারে না। মা এমন এক মানুষ।
আমার আম্মু কালো হলেও মুখটা অনেক মায়াবী ছিলো। অনেক ধার্মিক ছিলেন। আমাদের কাছে সবচেয়ে সুন্দর ছিলেন আম্মু। কিন্তু আব্বুর কাছে? সেজন্যই হয়তো উনি তৃতীয় বিয়ে করতে পেরেছিলেন। হ্যা আম্মু ছিলেন আব্বুর দ্বিতীয় স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী একবছরের মাথায় চলে যায়। সেটা নাহয় উহ্য থাকুক। আম্মু কালো তাই নানাভাই আব্বুকে বাহিরে পাঠানোর কমিটমেন্ট দিয়ে বিয়ে দিয়েছিলেন। বিয়ের কয়েকবছর চলে গেলো আব্বুকে নানাভাই মিডলইস্টে পাঠাতে চাইলে আব্বু রাজি হলেন না। উনি যেরকম মানুষ তার জন্য যে শুধু ইউরোপ কান্ট্রি মানায়! একে একে মাইশা আপু, আমি, মিনহার জন্ম হলো আম্মুর উপরও অত্যচার বাড়লো। শেষে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আম্মু নানাভাইকে জোর করে জায়গা বিক্রি করিয়ে আব্বুকে ফ্রান্স পাঠালেন। প্রথম প্রথম তো অবস্থা খুব ভালো, আম্মুও অনেক খুশি। কারন আব্বু ভালো একটা অবস্থানে আছেন। আস্তে আস্তে সময় অতিবাহিত হয় আর আব্বু আম্মুর দূরত্ব বাড়ে। আগে আব্বু দিনে তিন চার বার ফোন দিতেন এখন একদিন পর পর। তাও শুধু ঝগড়া করেন। আম্মু কিছু বলেন না শুধু কাঁদেন।
হুট করে দেখা গেলো দাদীমারও আচরণ পাল্টে গেলো। কথায় কথায় আম্মুকে মারার জন্য তেড়ে আসেন। আমাদেরকে দেখতেই পারেন না। আস্তে আস্তে আম্মুর সোনার সংসার হাতছাড়া হয়ে গেলো। এখন একটাকাও দাদীমাকে বলে নিয়ে যেতে হয়। খাবারগুলো ও সব দাদীমার ঘরে তালাবদ্ধ থাকে। আমরা সকালে ঘুম থেকে উঠে কখনও না খেয়ে মক্তবে যেতাম। আর আম্মু নিরবে চোখের পানি মুছতেন।
আমি তখন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি। একদিন কিছু কাগজ আসলো ফ্রান্স থেকে, আম্মুকে কাগজে সই করতে হবে। তাহলে নাকি আমরা সবাই ফ্রান্সে যেতে পারবো।
কিন্ত কাগজগুলো ইংরেজিতে লেখার বদলে ফ্রান্সিস ভাষায় কেন? আম্মুর সন্দেহ হওয়ায় সেগুলো নিয়ে খালামনির বাসায় গেলেন। ওমা! ভাষান্তর করে জানা গেলো আব্বুকে আরেকটা বিয়ের অনুমতি দিয়ে আম্মু সই করেছেন!
আম্মু যেন চোখে শর্ষেফুল দেখলেন, এটা কিভাবে সম্ভব? এখন আমি কি করবো কেথায় যাবো? হায় হুতাশ শুরু করলেন আম্মু। আমার আম্মু কালো হলেও, শিক্ষিত বুদ্ধিমতি মেয়ে। তাই খুঁজ নিয়ে জানলেন পাশের থানার একটা মেয়ের সাথে ফেইসবুকে প্রেম করে আব্বু ওকে ভিডিও কল এ বিয়ে করেছেন।
আম্মু এখন কি করবেন? আম্মু দাদীমাকে জানালে তিনি বিশ্বাসই করলেন না। পরবর্তীতে বললেন, "আমার ছেলে খাওয়াতে পারলে বিয়ে করুক দশটা, তোমার কি? সই দিয়ে দাও।
আম্মু রাজি হলেন না, দাদীমা আর ফুপুরা আম্মুকে অনেক মারতো আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতাম। একদিন আম্মু সহ্য করতে না পেরে দাদীমার হাতে থাকা রড ধরে ফেলেছিলেন। তখন দাদীমা বাড়িতে নালিশ বসিয়ে ছিলেন। আম্মু নাকি দাদীমাকে মেরে তক্তা বানিয়ে দিয়েছেন। শুনতাম আব্বু ফোনে দাদীমাকে বলতেন এত বেশি নির্যাতন যেন করা হয় যাতে আম্মু বাড়ি ছেড়ে চলে যান।
একদিন রাতে ফুপুর বড় ছেলে আম্মুর সাথে অশ্লীল কিছু করতে চাইলে আম্মু সাথে সাথে পাশের ঘরের আংকেলকে ডাক দেন।
পরে ওরা নিজেদের বাঁচাতে আম্মুকে নিয়ে যা বলেছিলো। আম্মু সহ্য করতে না পেরে তখনই সেজদায় লুটিয়ে পড়েছিলেন।
আপু তখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়তো। ও কিছুটা বুঝতো, তাই ও বললো চলো আম্মু আমরা নানুবাড়ি চলে যাই।
আম্মু বলেছিলেন, আমার সংসার ছেড়ে কেন যাবো? আমি গেলেই তো ওরা ওই বউকে ঘরে তুলবে। যা হয় হবে আমি আমার বাচ্চা সংসার ছেড়ে কোথাও যাবো না।
তারপর থেকে যেন অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়লো। এবার অন্য উপায়ে, কারন ওরা জানতো আম্মুকে অত্যাচার করে বিন্দুমাত্র নড়ানো যাবেনা।
আমাদের খাবার কাপড় নিয়ে সমস্যা শুরু করলেন, এমনকি ফুপু দাদীমা যখন তখন আমাদের মারা শুরু করলেন। ফুপাতো ভাই রাহিন তো আপুকে একদিন..
সেদিন আম্মু অনেক রেগেছিলেন এত বেশি যে আমরাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। শান্ত মানুষগুলা রাগলে যে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে সেদিন বুঝেছিলাম।
আমার আম্মু পাগল হয়ে গেছেন?
আমার জন্য, আমাকে দেখতে না পেয়ে, আমার অপেক্ষা করতে করতে কখন যে আমার মা অভিমানে ফুঁসে উঠেছেন। তারপরও পরম আদরে আমাকে সেই ছোট্ট মুমু বানিয়ে রেখেছেন তার অন্তরে। সেখানে তিনি আমায় আদর করেন, আমার যত্ন নেন, অজান্তেই সেই ছোট্ট মুমুর সাথে কথা বলেন।
আপুর মুখে এসব শুনতে শুনতে আমি ফ্লোরেই ধপ করে বসে পড়লাম। আমার সব স্বপ্ন আশা যে শেষ হয়ে গেলো,আমার আম্মু আমাকে আর চিনবে না। গলা জড়িয়ে ধরে বলবে না "আমার মুমু কতবড় হয়ে গেছে!"
কিছু না ভেবেই ডাক্তারের চেম্বারে দৌড় দিলাম। মাহাদি ও আমার সাথে পিছন পিছন আসলো। ও বুঝতে পারছে আমার মানসিক অবস্থা কেমন। তাই নিসাকে ওই সামলাচ্ছে।
---ডাক্তার সাহেব, আমার আম্মুকে কি ভালো করা যাবে না? আমি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং আমার হাজবেন্ড একজন ব্রেইন স্পেশালিষ্ট। আমাদের হেল্পের প্রয়োজন হলে বলুন।
--- দেখুন আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি৷ তবে উনার প্রচুর রেস্ট আর মানসিক সাপোর্ট প্রয়োজন। আমরা ঔষধ চালিয়ে যাবো আপনারা বাকি চেষ্টা করুন।
--- আম্মু কবে ডিসচার্জ হবেন? আমি উনাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই।
---আসলে উনার পাঁজরের কয়েকটা হাড় একেবারেই ভেঙ্গে গেছে। উনি নড়াচড়াও করতে পারবেন না। এখনও ছাড়ার সম্ভাবনা নেই, তাই সঠিক করে বলতে পারছি না।
---দেখুন ডাক্তার, যদি আরও ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করার প্রয়োজন হয় করুন। যত টাকা লাগে আমরা ব্যবস্থা করবো।
এতক্ষণে মাহাদি কথা বললো।
অনেকক্ষণ কথা চলার পর, চিকিৎসা বিষয়ক আলোচনা শেষে আমরা ফিরে আসলাম। সবাইকে বিদায় দিয়ে আমি আম্মুর পাশে এসে বসলাম। মাহাদি আমাদের বর্তমান বাড়িতে আপুদের সাথে থাকছে। আর আমার গোসল, খাওয়া, নামাজ সবকিছুই হাসপাতালেই চলছে। আল্লাহর কাছে মনেপ্রাণে দোয়া করছি, "আল্লাহ তুমি আমার আম্মুকে একেবারের জন্য ভালো করে দাও।আমি তোমার কাছে আর কিচ্ছু চাইনা।"
দুইদিন হয়ে গেছে আমি আম্মুর খাবার, চেকআপ সবকিছু একজন নার্স হিসেবে করছি। মনে পড়ে আম্মু আমাদের একসাথে বসিয়ে মুখে তুলে খাবার খাওয়াতেন। আমরা যখন বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে নানুবাড়িতে যাই তখন মামারাও বিয়ে করে ফেলেছেন। আম্মু তার বান্ধবীকে বড়মামার বউ করে নিয়ে এসেছেন। সুখেদুঃখে সবসময় দুজন দুজনের আত্মার আত্মীয় ছিলেন। কিন্তু আমরা যাওয়ার পর দাবার গুটি যেন বদলে যায়। সবকিছু অন্যরকম হয়ে যায়, সবাই যেন রাতারাতি বদলে গেছে । কথায় কথায় দুই মামী আম্মুকে খুঁচিয়ে কথা বলতো। তারা একজনের সাথে তিন তিনজনকে খাওয়াতে পারবেন না। তাদেরও সংসার আছে, ছেলেমেয়ে আছে। যার আপদ তার কাছে এদের পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। আমরা হাসলেও দোষ হতো, কিছু করলেও দোষ হতো। এমনকি কোনকিছুতে হাত দিলেও দোষ। একটু দুষ্টামি করলেই সবার গা জ্বলতো। তারপর তারা আম্মুর সাথে এমনভাবে কথা বলতো যে আম্মু রেগে গিয়ে আমাদের মারতেন। একদিন আমি বড়মামার মেয়ের পুতুল হাতে নিয়েছি দেখে ও আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইলে তা নিচে পড়ে ভেঙে যায়। তখন তার সে কি কান্না, পুতুলটা নাকি আমি ভেঙেছি। আমি বার বার না করার পরও মামী আমার কথা বিশ্বাস করেননি। আম্মু বিশ্বাস করলেও সেদিন মামী আম্মুকে বললেন,
---ওদের যখন ভালো জিনিসের এত শখ তো কাজ করে জিনিস কিনে দিলেই তো হয়। এখানে নবাবের বেটি হয়ে বসে খাবে আর আমার ছেলেমেয়েদের জ্বালাবে, জিনিস নষ্ট করবে এটা আমি সহ্য করতে পারবো না।
--- দেখ শিউলি আমি মানছি আমার মেয়ে ভেঙে ফেলেছে। ও তো ছোট বুঝলে তো এমন করতো না।
--- ছোট, বুঝেনা এসব বলে শাসন না করেই তোর মেয়েরা একদিন তোর কপাল পুড়াবে। বাপের মেয়েরা বাপের মতো হবেনা তো কার মতো হবে?
--- তুই একটা কথাকে অন্য কথায় নিয়ে যাচ্ছিস কেন?
--- কেন তোর লাগে নাকি? তাহলে আমার মেয়ের পুতুল এক্ষুনি এনে দে। এ বাড়ি থেকে ইজ্জতের সাথে কোথাও চলে যা।
--- এটা তো আমারও বাড়ি, এখান থেকে যাবো কেন? এভাবে কথা বলছিস কেন?
--- কারণ তুই বসে বসে খাচ্ছিস, সাথে চৌদ্দগুষ্টিকে বসিয়ে খাওয়াচ্ছিস সেটা সহ্য করতে পারছি না।
আম্মু শুধু তখন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলেন। তারও যে কিছু করার নেই৷ সেদিন আম্মু আমাকে বারোটা বেত একসাথে করে মেরেছিলেন।
আম্মু অল্প পড়ালেখা করেছেন আর যাও করেছেন তা মাদ্রাসায়। কি করবেন তিনি ভেবে পাচ্ছেন না। এমনসময় আমাদের মাথায় যে একটু ছায়া ছিলো সেটাও যেন চলে গেলো। নানুভাই হঠাৎ করে মারা গেলেন আর আমাদের চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেলো।
কথায় কথায় আমাদের অপমান হেয় করার চেষ্টায় থাকতেন মামীরা৷ আর সুযোগ পেলেই আমাদের তিনবোনদের মার খাওয়াতেন। আম্মু সব বুঝতেন তারপরও তাদের আচরণে রাগে আমাদের মারতেন। একদিন মিনহাকে এত মারলেন যে ও প্রায় এক সপ্তাহ জ্বরে ভুগলো।
কিছুদিনের মাথায় মামা আম্মুকে কিছু না বলে বাড়ির এককোনে টিন দিয়ে একটা ছোট্ট ঘর বানিয়ে দিলেন। তাও আম্মু খুশি উনি উনার মেয়েদের নিয়ে তো নিজের মতো থাকতে পারবেন। আব্বুর কাছ থেকে পাওয়া টাকা আর মামারা সামান্য যা টাকা দেন তা দিয়ে কোনমতে আমাদের দিন চলে যায়। আমি আর মিনহা প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হলেও আপুর পড়া বন্ধ হয়ে গেলো। আপু প্রতিদিন আম্মুর কাছে স্কুলে যাওয়ার আবদার করে আর আম্মু কেঁদে বুক ভাসান। আমরা বুঝতাম আম্মুর কষ্ট, কিন্তু মিনহা তো আর বুঝেনা। ও বিভিন্ন জিনিসের আবদার করতো আম্মুর কাছে।
একদিন প্রচুর ঝড়, শিলাবৃষ্টি হলো আম্মু তখন নামাজে। তিনি এত বেশি নামাজের ধ্যান এ মগ্ন যে বৃষ্টির পানি পড়ে আমাদের ঘর ভেসে যাচ্ছে খেয়াল করেন নি। সাথে আমরা যে ভিজে যাচ্ছি সেটা আম্মুর খেয়ালে আসেনি।
সবচেয়ে বেশি পানি পড়লো মিনহার উপর। পরদিন ওর এত জ্বর যে বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলো। সেদিন আম্মু থাকতে না পেরে উনার আরেক বান্ধবীর বাসায় গিয়েছিলেন সাহায্যের জন্য। মামারা যে বউয়ের কথা ছাড়া এক পাও ফেলেনা, আর নানুও চাইলেই কিছু বলতে পারেন না।
সেদিন উনার সেই বান্ধবীই আমাকে পালক দিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন। সাথে আম্মুকে একটা কেজি স্কুলে চাকরির ব্যবস্থা করেন। আম্মুও রাজি হয়ে যান আমাকে পালক দিতে। চলে যাই আমিও কোন অজানা বাবা মায়ের হাত ধরে।
উনারা আমাকে এত যত্নে আর আদরে রাখলেন যে মাঝে মাঝে ভুলেই যেতাম আমার আম্মু আছেন আরও দুইটা বোন আছে। হটাৎ কখনও মাঝরাতে কেঁদে উঠতাম আম্মুর জন্য, তখন আমার পালক মা এসে জড়িয়ে ধরে বলতেন, "মামনি এইতো তোমার আম্মু।" উনি এত আদর করার পরও কেন জানি উনাকে আম্মু ডাকতে পারিনি কোনদিন। আমি উনাকে মা ডাকতাম, উনিও কখনও আমায় জোর করেন নি।
এসব বসে ভাবছি আর আম্মু ঘুম থেকে জেগে উঠে জিজ্ঞেস করলেন,
--আমার মুমু কি আসছে মা?
-- এই মেয়েটাকে চিনো আম্মু? আমি একটা ছবি দেখিয়ে বললাম।
--- কে তোমার আম্মু? তুমি এটা কোথায় পেলে এটা তো আমার মুমুর ছবি। আহা! আমার মেয়েটাকে কত সুন্দর লাগছে!
--- একটুও কি মনে পড়ে না আম্মু চৌদ্দটি বছর কেটে গেছে। এখন তোমার মুমু বড় হয়ে গেছে। আমিই তোমার মুমু।
--- নাআআআ তুমি আমার মুমু না। আমার মুমু এখনও ছোট, বড্ড অভিমানী আমার মেয়েটি।
--- আম্মু গো আমিই সেই মুমু। এখন আর অভিমান করিনা। একবার বুকে নিয়ে আদর করোনা আম্মু..!
আমি কাঁদতেই থাকলাম আর আম্মু আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে পরবর্তীতে জ্ঞান হারালেন। ডাক্তার তাড়াতাড়ি এসে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে আমাকে রুম থেকে বের করে দিলেন।
আমি ওয়েটিংরুম এ বসে চোখের পানি মুছছি, আপু আর মিনহা এমন সময় এসে আমার পাশে বসলো। আপু আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, "আজ পাঁচ ছয় বছর হয়ে গেছে আম্মু আমাদের ও চিনেন না। ঘরে থাকতেই চাননা তোকে খুঁজতে বেরিয়ে যান। অনেক চেষ্টা করেছি উনাকে বুঝানোর কিন্তু পারিনি। ডাক্তার বলেছে মনে প্রচন্ড আঘাত লাগার কারণে এমন হয়েছে।"
কষ্টে আমি আরও বেশি কান্না শুরু করলাম, আমার জন্য আমার আম্মু আঘাত পেয়েছেন। "ইয়া আল্লাহ! আমাকে মাফ করো একবার৷ আমার আম্মুকে ফিরিয়ে দাও।"
হ্যা, আল্লাহ আমার কথা শুনেছেন। সেদিন রাতে আমার আম্মুর জ্ঞান ফিরেছিল। পুরো সুস্থ মানুষের মতো কথা বলছেন। আমাকে চিনেছেন। আম্মুকে জড়িয়ে ধরে মনের সুখে কেঁদেছি। আহ্ মায়ের বুকে কি সুখ যে মায়ের বুকে ঘুমায় সে বুঝে।
আম্মু সেদিন ডাক্তারকে ভালো মানুষের মতো বললেন,
--ডাক্তার আমি সুস্থ হয়ে গেছি, আমাকে বাড়ি যেতে দেন। কতদিন পর আমার তিনটা মেয়ে এক হয়েছে। আমি তাদের নিয়ে একসাথে একান্ত সময় কাটাতে চাই।
ডাক্তার অনেক বাঁধা দেওয়ার পরও তিনি শুনলেন না। আমরাও এতবছর পর আম্মুকে তার আপন রূপে পেয়ে খুশি।
বাড়িতে আসার পর আম্মু মাহাদিকে আমার খেয়াল রাখার কথা বললেন। নিসাকে অনেক আদর করলেন। আমি তো আর আম্মুর পাশ থেকে সরছিই না। পাজরের ব্যথার জন্য আম্মু বেশি নড়াচড়া করতে পারছেন না। তারপরও আমাদের তিনবোনকে নিজহাতে খাইয়ে দিলেন। বসে বসে নামাজ পড়লেন, তার দীর্ঘ মোনাজাতে শুধু ক্ষমা, ধৈর্য্য আর আমাদের ভালো কামনাটাই শুনলাম। তারপর আমাদের ভালো হয়ে চলার জন্য কিছু নসিহত করে আমার সেই চিরচেনা আম্মু আমার কোলে মাথা রেখে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। মৃত্যু তো আল্লাহর যখন হুকুম হয় তখনই হয়ে যায় এর থেকে কেউই মুখ ফেরাতে পারেনা। তবে আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছেন এটাই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। আমার আম্মুকে আমার মতো করে পেয়েছি। আমার প্রতি তার সব রাগ, অভিমান মিটে গিয়েছে। মা তো এমনই মহৎ, সন্তান শত অপরাধ করলেও ক্ষমা করে দেন।
যাওয়ার আগে ছোট বোন মিনহার বিয়ের ব্যবস্থা করলাম। নানুবাড়িতেও গিয়েছিলাম, সবাই আমাদের যা খাতিরযত্ন করলো। মনে পড়ে গেলো সেদিনকার কথা যেদিন তারাই আমাদের বাড়ির এককোনে আবর্জনার মতো ফেলে রেখেছিলো। আজ আমাদের সবকিছু আছে তাই তারাও আমাদের সাথে আছে! হায়রে মানুষ, মানুষ যে কত সুবিধাবাদী আর স্বার্থপর হতে পারে তাদেরকে দেখেই উপলব্ধি করলাম। তবে আমাদের আম্মু তো আমাদের এসব শিখাননি, তাই তাদের ক্ষমা করে দিলাম।
গিয়েছিলাম আব্বুর খুঁজখবর নিতে, শত হলেও আব্বু তো! দায়িত্ব আর কর্তব্যের হাতে যে আমরা সবাই বাঁধা। কিন্তু একি দেখলাম? এ ও হতে পারে? আমাদের বাড়ি থেকে বিদায় করে দেওয়ার একবছর পরই আব্বু এক্সিডেন্টে দুই পা হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। উনার ভালোবাসার নিশাত উনাকে এই অবস্থায় মেনে নিতে পারেনি তাই ডিভোর্স দিয়ে অন্যঘরে সুখের সংসার করছে। আর দাদীমা ছেলের এই অবস্থা সহ্য করতে না পেরে হার্ট অ্যাটাক এ মারা গেছেন। আর আব্বু এখন তার বোনদের দয়ায় চলছেন। ভাবলাম আম্মু কি উনাকে এই অবস্থায় ফেলে রেখে যেতেন? অবশ্যই না। বড় আপু আব্বুকে তার কাছে নিয়ে নিলো, আর আমি উনার ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করলাম। আব্বু অবশ্য এখনও তার নিশাতের জন্য কাঁদেন। তবুও জন্মদাতা পিতাকে তো ফেলে দেওয়া যায়না।
আমরা উনার ভালোবাসার ফসল না হলেও উনি আমাদের আম্মুর ভালোবাসা ছিলেন।
যাওয়ার পথে প্লেনে বসে বসেই এই ডায়েরি টা লেখা শেষ করলাম। জীবন কি বিচিত্র তাইনা? কিছু মানুষের কারনে কত সহজে একটা পরিবার ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। ফুরিয়ে যায় সব স্বাদ আহলাদ তা সেই মানুষগুলো বুঝতে পারেনা। হয়তো বুঝার চেষ্টাও করেনা। তবুও আল্লাহ্ সবাইকে সহিহ বুঝ দান করুন। সবার ভালোবাসা তাদের কাছে ফিরিয়ে দিন।
(যাত্রাপথে নামহীন কোন একজন)
- মেহজাবিন মুন
Tags:
Bengali Stories
Love Story
Mehzbin Mun
Ramanic Love Story
Romantic Story
ভালোবাসার গল্প
শিক্ষনীয় গল্প