গল্পঃ চুক্তি বিয়ে
লেখিকাঃ মেহজাবিন মুন
১ম কিস্তি...
সোহা প্লেন থেকে নামার পর সেই ২ ঘন্টা থেকে এয়ারপোর্ট এ বসে আছে। সবাই তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। আর তাকাবে না কেন এয়ারপোর্ট এ বউ এর সাজ সেজে একটা মেয়ে বসে আছে, তাও একলা!!কিন্তু এতক্ষন হয়ে গেলো কেউ আসছেনা কেন?
সে এই লন্ডনের মাটিতে কাউকে চিনেও না কিছু জানেও না।
"ইশ! বাড়ির ঠিকানা টা জানা উচিৎ ছিলো।"
সে বসে বসে যখন এসব ভাবছিলো তখনই কেউ একজন এসে জিজ্ঞেস করলো, "আপনি কি সোহা ম্যাডাম?"
- জ্বি, আপনি কে?
- আমি ড্রাইভার, সাহেব পাঠাইছেন। উনি একটা কাজে সকালে চলে গেছেন দেশের বাহিরে।
আশ্চর্য! আমি আসলাম আর কেউ নিতে আসলো না।
অবশ্য সোহা জানে কেউ আসবে না। কি আর করা, ড্রাইভারের সাথে চলে আসলো বাড়িতে। যখন গাড়ি ঢুকছে সোহা তো অবাক! এত্ত সুন্দর বাড়ি..! বিরাট বড় লন, নানাধরনের ফুলের গাছ, সুইমিং পুল। এত্ত সুন্দর বাড়ি সোহা কখনো দেখেনি। অবশ্য ওর এসবে কিছু যায় আসেনা, সে তো কিছুদিনের বউ হয়ে এসেছে এ বাড়িতে।
গাড়ি থেকে নামার পর এলিসা নামের এক কাজের মেয়ে এসে ওকে ড্রইংরুমে নিয়ে গেল। মেয়েটিকে কাজের মেয়ে নয় দেখে মেমসাহেব লাগে। আরও একজন আসলো ট্রে ভর্তি নাস্তা নিয়ে। সবাই একি ধরণের পোশাক পরেছে। ও মনে মনে ভাবছে যাদের বাড়িতে আসলাম তাদের কেউ এখন ও সামনে আসলো না। একটু পরে রুম এ একজন মধ্যবয়সী সুন্দরী মহিলা ঢুকলেন চোখ মুছে মুছে। মনে হয় এতক্ষন থেকে কাঁদছিলেন।
- তুমি এসেছো মা?
- জ্বি, আপনি নিশ্চয় এ বাড়ির মালিক?
- মালিক নয় , মা বলে ডাকতে পারো। আমি তোমার শাশুড়ি মা।
সোহা মনে মনে ভাবছে "যার বউ হয়ে আসলাম, এখনও তার দেখা পেলাম না। অহ্ উনি তো আবার অসুস্থ"।
এমন সময় দুতলার একটা রুম থেকে ভয়ংকর রকম আওয়াজ আর চিৎকার আসতে লাগলো। মহিলাটি চমকে উঠে দৌড় দিলেন। কিছু না বুঝে সোহা ও উনার পিছু পিছু আসলো। এলিসা পেছন থেকে বারবার ডাকছিল ম্যাডাম আপনি ওদিকে যাবেন না। আপনি নেমে আসেন। কিন্তু সোহা তখন কারও কথা শোনার মোড এ ছিলো না।
ও রুমে এসে যা দেখলো তাতে ওর রক্ত হিম হয়ে গেলো। একজন সুদর্শন পুরুষ মানুষ নিজের হাত কাটছেন ছুরি দিয়ে, পাশে একজন পুরুষ নার্স অজ্ঞান হয়ে আছেন। ঘরের সবকিছু লন্ডবন্ড করা। মহিলাটি জোরে চিৎকার করে এসে ছেলেটিকে ধরলেন। সাথে সাথে বাথরুম থেকে আরও দুজন পুরুষ বেরিয়ে এলো, দেখে মনে হলো ডাক্তার।
ওরা বললো, "ম্যাম আপনি ছিলেন না হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে পাগলামি শুরু করলেন, আমরা আটকাতে গেছি উনি বাড়ি মেরে জনকে ফেলে দিছেন। তাই আমরা ভয়ে বাথরুমে গিয়ে ঢুুকেছি। "
মহিলা ধমক দিয়ে বললেন, এখন ওকে শান্ত করো, রক্ত বন্ধ করো। ছেলেটি কেমন যেন মায়ের বুকে মাথা লুকিয়ে শান্ত হয়ে গেলো। ডাক্তার ওকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে ব্যান্ডেজ করতে বসলেন। আর অন্য ডাক্তার নার্সকে জ্ঞান ফেরালেন।
সোহা জিজ্ঞেস করলো, মা উনি কে?
- ও আমার ছেলে তন্ময়, যার বউ হয়ে এসেছো। মা ও এখন একটু অসুস্থ।
সোহা মাথায় হাত দিয়ে সেইখানে ফ্লোর এ বসে গেলো। অসুস্থ কি ও তো বদ্ধ উন্মাদ...!
ইয়া আল্লাহ আমার কপালে এ কি রাখছো বলে সোহা কাঁদতে লাগলো।
শাশুড়ি এসে ওকে ধরে উঠালেন। তারপর জড়িয়ে ধরে উনার রুম এ নিয়ে গেলেন।
সোহা বললো -আপনারা একি করলেন? আমাকে তো আপনারা এভাবে বলেন নি? আমি তো এরকম চুক্তি করিনি মা, আমি এসব পারবো না। আমাকে ক্ষমা করেন এগুলা থেকে মুক্তি দেন। বলে উনার পায়ের কাছে বসে কাঁদতে লাগলো।
শাশুড়ি চুপচাপ শুনলেন।
তারপর ওকে আদর করিয়ে পাশে বসিয়ে বললেন,
- মা, আমার একটা মাত্র ছেলে, তুমি এভাবে বলিও না। তুমি পারবে মা, তুমি যেভাবে হোক আমার ছেলেকে ভাল করে দাও। তুমি যা শুনছো তা ঠিক, আমার ছেলে একজন ডাক্তার, কিন্তু নিয়তির কি পরিহাস, আমার ছেলেই আজ ডাক্তারের সরণাপন্য।
- আপনি আমাকে খুলে বলুন মা কি হয়েছে উনার.?
- শুনবে তুমি? তার আগে কথা দাও মা যাই হোক তুমি আমার ছেলেকে ছেড়ে চলে যাবে না? বলো?
- আমি চেষ্টা করবো আপনি বলেন।
- সোহা মা তুমি যে এগ্রিমেন্ট এ সাইন করছো সেটা কি ভালভাবে পড়েছো?
- মা এসব বাদ দিন আপনি আগে বলুন।
আমার ছেলে ভিষন অসুস্থ মা, তাই আজকেও তোমাকে আনতে যেতে পারিনি। তোমার শশুর আজ হঠাৎ করে দেশে ঔষদ আনতে গেছেন। আমরা কি না চেষ্টা করছি, কিন্তু কিচ্ছু হচ্ছে না। বলে মহিলা কান্না শুরু করলেন। সোহার মনেও প্রভাব পড়লো উনার কান্না দেখে।
- বলুন মা কেমনে কি হলো, আগে শুনি।
তখন আবার নিচে থেকে কথা শুনা গেলো। উনি বললেন তোমার আসার দরকার নেই, আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসছি বলে উনি তাড়াহোড়ো করে চলে গেলেন। সোহা ভাবতে লাগলো এ বাড়িতে আসার পর থেকে শুধু রহস্যময় লাগছে সব। কিন্তু মহিলাটি মানে শাশুড়ি কে মনে হলো ভাল মানুষ।
ও বসে বসে ভাবতে লাগলো বাড়িতে সবাই কত চিন্তা করছে আমার জন্য কত খুশি হয়ে আমাকে বউ সাজিয়ে বিদায় দিলো। ওরা তো জানলো না সোহা অগ্নি পরীক্ষার সম্মোখীন হয়েছে।
- কি ভাবছো মা? হঠাৎ এমন প্রশ্নে ও চমকে উঠলো। চেয়ে দেখলো ওর শাশুড়ি দাড়িয়ে আছেন।
- না মা, কি হয়েছে বাহিরে?
- ও কিছুনা তুমি এসব নিয়ে ভেবো না। চলো তোমাকে তন্ময় এর কথা বলি।
ও আর কিছু না বলে চুপচাপ উনার কথা শুনতে লাগলো। উনি বলতে লাগলেন,
- আমার ছেলে যখন ডাক্তারি ইন্টার্নিশিপ এ ছিলো তখন একটা মেয়ের সাথে প্রেম হয়, আমরা জেনে খুশি হই মেনে নেই ওদের সম্পর্ক কে। একটা মাত্র ছেলে, তাই চাকরি তে জয়েন দেওয়ার সাথে সাথে বিয়ে দেই সেই মেয়েটার সাথে। কিন্তু পরে বুঝলাম মেয়েটা উশ্রিঙ্খল ছিল। আমরা অনেক বুঝিয়েছি তন্ময় ও বুঝাতো, মাঝে মাঝে জগড়া করতো দুজনে ভিষন। কিন্তু আমার ছেলেটা ওকে খুব ভালবাসতো। একদিন কাউকে কিছু না বলে অনেক টাকা আর গহনা নিয়ে মেয়েটি চলে গেলো। ওর উদ্দেশ্য ও ছিল এটি। সম্পদ দেখে আমার ছেলে কে প্রেমে ফাঁসিয়েছে। তন্ময় সাথে সাথে ওকে আনতে গেছিলো, কিন্তু যখন আসলো একাই আসলো আর অনেক নিরব হয়ে গেলো। ২/৩ দিনের ভিতর পাগলামি বেড়ে গেলো। আর আজ তিনটা মাস হয়ে গেলো আমার ছেলের একটু ও কমলো না, আরও বদ্ধ পাগল হয়ে গেলো। মেন্টাল হসপিটাল এ পাঠাইনি আমরা, তার বদলে টাকার চিন্তা না করে ঘরেই নিবিড় পরিচর্যার ব্যবস্থা করেছি, ৩-৪ জন ডাক্তার নার্স রেখেছি। আমার ছেলের জীবন শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাচ্ছে, মা আমি তোমার পায়ে ধরবো, হাতে ধরবো তুমি যেওনা।" এই বলে মহিলা সোহার পা ধরতে গেলেন।
সোহা সরে গিয়ে বললো "কি করছেন মা। আমি তো আছি, আপনি চিন্তা করবেন না।" তাছাড়া সোহা চুক্তির কথাও ভাবতে লাগলো, চুক্তিতে লিখা ছিল, যেভাবেই হোক ছয়মাস পুরো করতে হবে। ও বললো আপনি আমায় তন্ময় সাহেবের পাশের রুম এ থাকার ব্যবস্থা করুন। আমি ওইখানে ই থাকবো। উনি খুশি হয়ে বললেন, আমি এক্ষুনি ব্যবস্থা করছি। উনার হাসিমাখা মুখ দেখে সোহা সব ভুলে গেলো। মায়েরা এমনই হয়, বাচ্চা যেমন ই হোক মায়ের কাছে তার বাচ্চাই বড়।
ও বেরিয়ে এসে তন্ময় এর রুমে ডুকলো, এই প্রথম নিজের স্বামীর দিকে তাকালো। স্বামী কেমন করে হয়? পাগল কি বিয়ে করতে পারে ও ভাবলো। যাক পরে ভাবা যাবে এসব, বলে ও এগিয়ে গেলো তন্ময়ের বিছানার দিকে।
ছেলেটা ঘুমিয়ে আছে, এত সুন্দর মায়াবী মুখ হয় কারও? মাথায় কুঁকড়াচুল, উন্নত নাসিকা, ফর্সা একজন মানুষ। কতো নিষ্পাপ লাগছে, শুধু খাওয়া ঘুম আর পাগলামির কারনে গায়ের রং মলিন লাগছে। চেহারায় মনে হচ্ছে ক্লান্তি আর প্রচন্ড কষ্টের চাপ পড়ে আছে। এরকম সুন্দর নিষ্পাপ চেহারার ছেলের সাথে কেউ এরকম করতে পারে ভেবেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। সোহা তন্ময়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ভাবতে লাগলো, যতো যাই হোক আমি যাবো না।
এমন সময় মহিলা রুম এ এসে ডুকলেন, সাথে এলিসা। বললেন, " মা আজ থেকে তোমার যা লাগবে শুধু বলিও আমাকে " আর কোন কাজ বা কিছু থাকলে এলিসা কে বলবে ও সাহায্য করবে।
সোহা বললো, ঠিক আছে মা, আপনি এখন আমাকে ওর সাথে একটু একা থাকতে দেন। আমি এই ঘরেই এখন কিছুক্ষন থাকবো। উনি চুপচাপ এলিসা কে নিয়ে চলে গেলেন ও ওইখানেইন ঘুমিয়ে পড়লো।
কিন্তু সকালে উঠে যা দেখলোএটার জন্য প্রস্তুত ছিলনা সোহা।
সোহা ঘুম থেকে উঠে দেখে তার পাশে তন্ময় ছুরি নিয়ে বসে আছে। চোখ দুটো লাল, রাগে মুখ থেকে একধরনের আওয়াজ বের হচ্ছে। সোহা এই দৃশ্য দেখে ভয়ে চোখ বন্ধ করে চিৎকার দিল। পাশের রুম থেকে এলিসা দৌড়ে আসলো, ততক্ষনে তন্ময় ওর হাতে কোপ বসিয়ে দিয়েছে, এলিসাও ম্যাম বলে জোরে চিৎকার দিয়ে গিয়ে সোহা কে ধরলো। ওদের চিৎকার শুনে মা আসলেন, দেখলেন তন্ময় আবার ও ছুরি হাতে এগিয়ে যাচ্ছে।
- না তন্ময়, বলে মা দৌড়ে গিয়ে তন্ময় কে ধরলেন। এলিসা কে বললেন গিয়ে সোহার রক্ত বন্ধ করতে। ডাক্তার রা ও আসলেন এ সময়। উনারা সোহাকে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। সোহা তখন ও ভয়ে কাঁপছিল, ওকে পাশের রুম এ এলিসা নিয়ে যাওয়ার পর সোহা বললো আমি থাকবো না, আমি চলে যাবো, চলে যাবো আমি। ও তন্ময়ের সেই ভয়ঙ্কর মুখ ভুলতে পারছে না।
এলিসা বললো, ম্যাম আপনি স্যার কে ভুল বুঝবেন না, উনি অনেক ভাল মানুষ। উনি পাগল হন নি, উনাকে পাগল করে দেওয়া হয়েছে। উনি এমন ছিলেন না।
এসময় শাশুড়ি এসে ওর পাশে বসলেন।
বললেন - মা, ও মেয়েদের দেখলেই ভয় পায়, ও মনে করে সব মেয়েরা ওকে মারবে, হঠাৎ করে তোমাকে পাশে দেখে ভয়ে আরও এমন করছে তুমি ভুল বুঝনা মা।
- তাহলে তো এই কাজ আমার জন্য আর ও কঠিন মা, সোহা বললো।
- তুমি পারবে মা, তুমি চিন্তা করিও না, তোমার বাজেট আরও বাড়িয়ে দেবো।
সাথে সাথে ওর বাড়ির কথা মনে পড়ে গেলো, কিভাবে ও এখানে আসছে, বাবা মা কতো খুশি হয়েছে মেয়ে টা লন্ডনে চাকরি পেয়ে গেছে, বিয়েও হয়ে গেছে, এখন আর তাদের কোন দুঃখ থাকবে না।
সোহা নিম্নবিত্ত ঘরের মেয়ে। বাবা দিনমজুর, পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সে দ্বিতীয়। সোহা সবসময়ই পড়ালেখায় ভালো। ওর পড়ার প্রতি আগ্রহ দেখে ওর বড় বোন পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছে। কারন একসাথে সবার লেখাপড়া চালানো সম্ভব নয়।
সোহার মেধার জন্য ওর স্যার রা ওকে সাহায্য করেছেন। ক্লাশ নাইন থেকে ও টিউশনি করে। এতে ওর আর ছোট ভাইবোন গুলার খাতাকলম এর ব্যবস্থা হয়ে যেত। এরকম টিউশনি করে আর মেধাবৃত্তি পেয়ে সে গ্র্যাজুয়েট কমপ্লিট করেছে। এবং রেজাল্ট ও অনেক ভাল। মনে অনেক স্বপ্ন ছিল ভাল একটা চাকরি পাবে। বাবা মায়ের কষ্ট দূর করবে, বোনটার ও বিয়ে দেবে। কিন্তু চাকরি খুঁজতে গিয়ে ও বুঝেছে বাস্তবতা কত কঠিন। সবাই মুখে বড় বড় কথা বলে আর তলে তলে স্বার্থসিদ্ধির ধান্ধা।
সোহা অনেক সুন্দরী মেয়ে। উজ্জ্বল ফর্সা গায়ের রং, মায়াবী চেহারা, গভীর কালো চোখে একধরনের মায়া। যে কেউ এই মায়ায় হারিয়ে যেতে পারে। এটা সোহার জন্য সবচেয়ে বড় বাঁধা। তারপর ও সোহা হাল ছাড়েনি, ছোটবড় যেকোন একধরনের চাকরির জন্য ছোটাছোটি করছে। কিন্তু সবাই চাকরির বদলে খারাপ চোখে তাকায়। কিন্তু চাকরির জন্য তো নিজের ইজ্জত বিক্রি করতে পারেনা। চারিদিক যখন হতাশায় ডুবে গেছে ওর তখন সোহার একজন পরিচিত আপা বললেন, অমুক জায়গায় একজন বিখ্যাত ব্যক্তি আছেন। খুব ভাল মানুষ, উনার দেশে বিদেশে ব্যবসা, উনার কাছে গেলে কিছু একটা হতে পারে। আমি বলে দিছি উনার পি এস কে। তুমি যাও একবার, উনি আবার দেশে থাকেন না।
সোহা বললো, আমি আজই যাচ্ছি।
সোহা একটু ফ্রেস হয়ে একটু ভালো কাপড় পরে রেডি হয়ে গেলো। উনার অফিসে গিয়ে দেখে এত বড় অফিস, ও তো ভয়েই শেষ ঢুকতে পারবে কি না। আগে থেকে বলে রাখা দেখে ও ঢুকতে পারলো।
উনি মেয়েটা কে দেখে নিজের মেয়ের মতো এনে বসালেন। তারপর যতন করে বসিয়ে নাস্তা খাইয়ে ওর বায়োডাটা দেখলেন সব শুনলেন। আসলে তখন উনার মনে ছিলো অন্য চিন্তা। সোহা ভাবতে পারেনি এত বড়লোক একজন মানুষ এত ভাল আর উদার হতে পারে, তাই উনার আদর দেখে সোহা কেঁদে ফেললো।
উনি বললেন, দেখো মা সব মানুষ ভাল হয়না। আর কিছু কিছু ভালো মানুষের জীবন ও সুখের হয়না। আমিও তাদের মধ্যে একজন, তুমি যদি আমাকে বিশ্বাস করো, তাহলে আমি তোমাকে চাকরি দিতে পারি। কিন্তু তার আগে আমার কিছু কথা শুনতে হবে। আর এসব কথা এখানে বলা যাবেনা, তুমি যদি আমাকে বাবার মতো বিশ্বাস করো তাহলে এই আমার বাসার ঠিকানা তুমি কাল সকালে আমার বাসায় আসতে পারো।
সোহা বললো,- কি যে বলেন স্যার আমি আপনার মতো মানুষকে কিভাবে বিশ্বাস করবো না। আমি আগামীকাল আসবো ইনশাআল্লাহ।
পরদিন সোহা উনার বাসায় গেলো। বাসা দেখেই বুঝলো আসলেই খুব উচ্চবিত্ত মানুষ এরা। উনি ওকে নিজের মেয়ের মতো এনে বসালেন।
কাজের ছেলে নাস্তা নিয়ে আসলো, হয়তো আগে থেকেই বলা।
- আমি বাড়ি থেকে এখন খেয়ে এসেছি স্যার।
- এটা আমার অফিস নয় মা, তাই আমাকে আঙ্কেল ডাকতে পারো। আর খেয়ে আসলে কি হলো, এখন তো তোমাদের খাওয়ার সময়,
খাও বেশি বেশি করে খাও।
তারপর বললেন, তুমি কি লন্ডন যাবে?
- সোহা এ কথা শুনে চমকে উঠলো,
- কি বলছেন আঙ্কেল আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
উনি বললেন দেখো মা তোমার একটা চাকরির দরকার আর আমার তোমার মতো একটা মেয়ের দরকার।
তোমাকে আমি আমার ছেলের বউ করে নিয়ে যেতে চাই।
- কি বলছেন আপনি? সোহা দাঁড়িয়ে গেলো।
- বসো মা আমি বলছি তোমাকে সব।
সোহা বসলো, তবে আগের মতো স্বাভাবিক হতে পারলো না।
তিনি বললেন, আমার নাম তো জানই আমি মিনহাজ চৌধুরী, দেশে বিদেশে আমার বিজনেস, কিন্তু আমার ছেলে তা হতে চায়নি। ছোটবেলা থেকে ওর ইচ্ছা ছিলো ডাক্তার হওয়া। আমরা ওকে ডাক্তার বানালাম। কিন্তু কি ভাগ্য, কিছুদিন যেতে না যেতেই ও অসুস্থ হয়ে গেছে। ওর চিকিৎসার জন্য একজন নার্স প্রয়োজন। তাই তুমি যদি যেতে চাও।
- কিন্তু আমি তো নার্স নই।
- সমস্যা নেই, ওখানে অনেক নার্স আছে তুমি শুধু আমার ছেলের একটু খেয়াল রাখবে। আর এজন্য তোমাকে মাসে ২ লক্ষ টাকা করে বেতন দেবো।
সোহা এই কথা শুনে চোখ কপালে তুলে ফেললো।, এতো টাকা..!
- আমি যদি কিছু না করি, তাহলে এত টাকা কেন দিবেন?
- তোমার চাকরির দরকার চাকরি করবে কি না বলো?
- কিন্তু আঙ্কেল আমার বাবা মা রাজি হবেন না।
সেটাও আমি ভেবে রেখেছি। তোমার বাবা মায়ের কাছে আমি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবো।
- কি কথা বলছেন আপনি?
- হুমম তা শুধু চুক্তি পত্রে থাকবে। উনারা জানবেন না, পরে তুমি যদি ইচ্ছা করো আমার ছেলেকে বিয়ে করবে আমরা মেনে নেবো।
কিন্তু তোমাকে ছয় মাস সময় দেয়া হবে, এর ভিতরে তুমি আমার ছেলেকে সুস্থ করতে হবে। ছয়মাস পর্যন্ত চুক্তি করা থাকবে।
এখন তুমি ভাবো কি করবে
সোহা ভাবতে লাগলো কি করবে,
একদিকে ছোট ছোট ভাইবোন। অন্যদিকে ওর জীবন এর এতবড় একটা রিস্ক। মনে পড়লো ভাইটা কলেজে ভর্তি হবে বলেছে। ছোট বোন আর ভাইর হাসিমাখা মুখ আর আবদার। বড় বোনের ক্লান্তিমাখা হাসি। এখন ও বোনের বিয়ে হয়নি। এই বয়সে বাবার এত কিছু সামলানো কত কষ্টের।
ও আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলো, "আপনার ছেলের অসুখ টা কি আগে বলেন।"
- তুমি গেলেই তা দেখতে পাবে।
- কান্নামাখা মুখ নিয়ে বললো আমি রাজি।
মিনহাজ সাহেবের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। আসলে উনি জানতেন মেয়েটার যে অবস্থা রাজি হবেই।
উনি সমবেদনা ভরা গলায় বললেন - মা আমি তোমার ক্ষতি হতে দিবো না। তুমি চিন্তা করিও না।
তারপর বললেন, এই যে চুক্তিনামা, তুমি সাইন করে দাও, আমি তোমাকে এক্ষুনি অর্ধেক টাকা দিয়ে দেবো।
ও অবাক করা চোখে তাকালো। চুক্তিনামায় লিখা সোহা ছয়মাসের জন্য তন্ময় চৌধুরীর বউ হয়ে যাচ্ছে, বিনিময়ে ১২ লক্ষ টাকা পাচ্ছে। কি অদ্ভুত!! টাকার বিনিময়ে বউ!
উনি বললেন আমার বিশ্বাস ছিলো তুমি রাজি হবে, তাই আগেই পেপার রেডি করে ফেলেছি।
সোহা সাইন করে এডভান্স ৬ লক্ষ টাকা নিয়ে বাড়ি আসলো। কিন্তু বাড়ি এসে ও কোন কথা না বলে নিজের ঘরে ঢুকে গেলো। টাকার কথা বাবাকে কিভাবে বলবে, মনে চিন্তার ঝড় চলছে।
২য় কিস্তি...
সন্ধার পরে ওর বাবা ঘরে এসে শুনলেন সোহা কারও সাথে কথা বলেনি, খায়নি। উনি সোহার রুম এ গিয়ে সোহাকে নিরব দেখে মনে করলেন মেয়েটা চাকরি পাচ্ছেনা দেখে হয়ত হতাশায় আছে।তিনি সোহার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, মা রে, চাকরি হচ্ছেনা বলে কি মন খারাপ? মন খারাপ করিস না, আল্লাহ চান তো কিছু একটা হয়ে যাবে।
সোহা বলল, "না বাবা, আমি চিন্তা করছি না, কিছু একটা হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
সোহা মনে মনে ভাবছে, সব ঠিক হয়ে গেছে বাবা। তুমি শুধু দোয়া করো তোমার মেয়ে যেন সফল হতে পারে।
বাবা বললেন, তুই এখন ঘুমা মা আজ অনেক দখল গেছে তোর উপর, আজ চাকরি পাসনি বলে চিন্তা করিস না।
পরদিন সকালে সোহা তার বাবাকে বললো, বাবা কাজে যেওনা, আজ একজন মেহমান আসবেন।
- কে আসবে মা? আমাকে তো বললি না কাল?
- কাল যেখানে গিয়েছিলাম উনি আসবেন।
সকাল ১০টায় মিনহাজ সাহেব সোহাদের বাড়িতে আসলেন। তাদের খুব ছোট ঘর, নিম্নবিত্ত বলতে যা বুঝায়। কিন্তু তিনি কোন অহংকার না করে সোহার বাবার পাশে বসলেন। চা নাস্তা শেষে মিনহাজ চৌধুরী বললেন, ভাই সাহেব, আমি এসেই তো আগে নাস্তা খাওয়া শুরু করলাম। এবার আসল কথায় আসি, যদি কিছু মনে না করেন।
- না সাহেব, কিছু মনে করবো না আপনি বলেন। আর আপনাকে তো বসার জায়গাও দিতে পারিনি।
- এসব বলবেন না ভাই! আর আমাকে সাহেব বা স্যার বলার ও দরকার নেই, আমরা এখন থেকে বিয়াই হতে যাচ্ছি।
আপনি কি সোহা মা কে আমাকে দিয়ে দেবেন?
- কি বলছেন সাহেব? বুঝতে পারছি না.! সোহার বাবা অবাক হয়ে গেলেন উনার কথা শুনে।
মিনহাজ সাহেব বললেন, অবাক হওয়ার কিছু নেই ভাই, সোহা মেধা আর গুনবতী একটা মেয়ে। আমি ওকে আমার ছেলের বউ করতে পারলে তা আমার সৌভাগ্য হবে।
সোহার বাবা এটা শুনে আনন্দে কেঁদে ফেললেন। বললেন, আমি জানি আমার মেয়ে আমার কোন পূন্যের ফল।
কিন্তু ভাই আমার বড় মেয়েকে যে এখন ও বিয়ে দিতে পারিনি। তাছাড়া আমার সোহার স্বপ্ন ছিল চাকরি করবে, ভাই বোন গুলোকে পড়াবে।
- আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমি আপনাদের সব খবর নিয়ে এসেছি, আপনার বড় মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা ও হয়ে গেছে। জামাই আমার কোম্পানি তে চাকরি করে, আর সোহার ও চাকরির ব্যবস্থা হয়ে গেছে যাতে সোহা আপনাদের পরিবারে সাহায্য করতে পারে। লন্ডনে আমার পরিচিত একজনের মাধ্যমে ভাল একটা কোম্পানি তে চাকরির ব্যবস্থা করছি।
- কি বলছেন? আমার সোহা লন্ডনে যাবে? উনি বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন।
- আমরা সবাই তো লন্ডনে থাকি, ঐখানে আমার ছেলে ডাক্তারি করে।
- সোহার বাবা বললেন, না ভাই, এত দূরে আমার মেয়ে কেমনে কি করবে? আমার দরকার নেই।
সোহা তার বাবার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তার বাবাকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বুঝালো, - বাবা তুুমি চিন্তা করোনা, উনি আমাদের জন্য এতকিছু করছেন। উনি খুব ভালো মানুষ, তাছাড়া বিয়েতো বড় নয়, আমি চাকরি করবো ওখানে গিয়ে। দেশের মানুষ খুব স্বার্থপর বাবা। এখানে মেধার কোন দাম নেই।
- কিন্তু তুই লন্ডনে গিয়ে থাকবি কিভাবে? যদি কিছু হয়?
- কিচ্ছু হবেনা বাবা। তুমি আরও গর্ব করে বলবে আমার মেয়ে লন্ডন চাকরি করে। তাছাড়া ভাইবোনদের ও ভবিষ্যতের একটা ব্যবস্থা হবে। তুমি না করো না বাবা।
সোহার মা ও বললেন আমার মেয়ের উপর বিশ্বাস আছে তুমি রাজি হয়ে যাও। সোহার বাবা অনেক্ষন পরে ফিরে এসে বললেন, ঠিক আছে ভাই সাহেব, আমি রাজি। কিন্তু আমার বড় মেয়ের বিয়েটা আগে হোক।
মিনহাজ সাহেব খুশি হয়ে বললেন, ঠিক আছে আমি সব ব্যবস্থা করছি। কিন্তু ভাই ছেলে আমার আসতে পারবেনা। তাই বিয়ের অনু্ষ্ঠান লন্ডনে হবে যেদিন সোহা যাবে। আর সোহার এডভান্স বেতনের ও ব্যবস্থা করেছি, তা সোহার কাছে পৌছে দেবো।
তারপর উনি বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসলেন। উনি চলে আসার সময় সোহা উনাকে এগিয়ে দিতে এসে বললো, আঙ্কেল আপনার কাছে আমার অনুরোধ, আপনি যা কিছুই ব্যবস্থা করেন কিন্তু আমি আমার টাকা থেকে খরচ করবো।
উনি হাসিমুখে বললেন, আমি জানি মা তুমি কেমন মেয়ে। তুমি তোমার মত করেই সব করো। আমি কিছু বলবোনা।
কিছুদিনের ভিতরে বোনের বিয়ে, বাবা-মা ভাই বোনের থাকা খাওয়ার সব ব্যবস্থা করলো সোহা। ওর ভাই বোনের পড়ালেখার জন্য কিছু টাকা একটা একাউন্ট করে রেখে দিল যাতে সময়মত ওরা তুলতে পারে। তারপর সোহা নতুন এক অজানার পথে পাড়ি দিল।
লন্ডনে আসার দিন ওর বাবা মায়ের ইচ্ছাতেই বউ সেজেছিল। উনারা জানেন আসার সাথে সাথে সোহার বিয়ে হবে। কত খুশি হয়ে কত ধুমধাম করে এয়ারপোর্ট এ সবাই এগিয়ে দিল। কিন্তু সোহা তো জানে চুক্তি বিয়ে আবার বিয়ে হয় কিভাবে? এই বিয়ের যে কোন দাম নেই, কোন স্বীকৃতি নেই। এমন কি কেউ তাকে আনতেও যায়নি এয়ারপোর্ট এ। অবশ্য এখানে আসার পর কথা আলাদা, যা ভাবছিল এর চেয়ে কঠিন কিছুর সম্মুখীন হতে হলো। কিন্তু সেই মহান মানুষ টা কোথায়? যে তাকে এতদূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। তাকে একবার জিজ্ঞেস করতে হবে কেন তার সাথে এমন করলেন? টাকা দিয়ে কি একটা মেয়ের বিশ্বাস কিনা যায়? উনাকে এত বিশ্বাস শ্রদ্ধা করলো আর বিনিময়ে কি পেলো.?
কিন্তু আমিও হাল ছাড়বো না, এর শেষ দেখেই ছাড়বো। সোহা চোখের পানি মুছে ফেললো। তারপর উঠে দাঁড়ালো তন্ময়ের রুমে যাওয়ার জন্য।
তন্ময়ের মা বাধা দিয়ে বললেন, এখন যেওনা মা, এখনও তন্ময়ের ঘোর কাটেনি, মাথা গরম। ওকে বেধে রাখা হয়েছে।
- না মা, আমাকে এখনই যেতে হবে, আমি এর শেষ কিভাবে হয় দেখতে চাই।
তন্ময় চুপচাপ শুয়ে ছিল। সোহাকে দেখে চিৎকার দিয়ে উঠলো কিন্তু হাত পা বাধা থাকায় কিছু করতে পারলো না
সোহা ডাক্তার আর নার্সকে বললো, আপনারা রুম থেকে চলে যান। যেহেতু উনার হাতপা বাধা উনি আমাকে কিছু করতে পারবেন না।
সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর সোহা গিয়ে তন্ময়ের পাশে বসলো। কিন্তু তন্ময়ের চোখ মুখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে।
সোহা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, দেখো আমি তোমাকে মারতে আসিনি, আমি তোমাকে ভালো করতে আসছি, আমার হাতে কি কিছু আছে তোমাকে মারার জন্য?
তন্ময় রাগ আর ভয়ের কারনে অদ্ভুদ শব্দ করতে লাগলো। কিন্তু সোহা ঘাবড়ালো না।,
- তুমি ঔষদ খেয়ে চুপচাপ ঘুমাও, তুমি ঘুমালে দেখবে ভালো হয়ে যাবে।
- না তুমি আমাকে মারবে, তুমি ঔষদ দিয়ে আমাকে মারতে চাও, আমি ঘোমাবো না, ঔষদ ও খাবো না। ও বিছানায় হাত পা চুড়া শুরু করলো।
- ঠিক আছে, ঠিক আছে খেতে হবে না ঘুমাতে হবে না। আমি পাশে বসে আছি, তুমি শুয়ে থাকো।
- না, তুমি যাও, তুমি আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাও।
সোহা দূরে একটা চেয়ার নিয়ে বসলো। তন্ময় খুব সতর্কভাবে চেয়ে থাকলো। যদি মেয়েটা এসে ওকে মেরে ফেলে..?
সোহা দূরে বসে তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, কি সুন্দর মায়াবী একজন মানুষ, আজ তার রোগী-হাসপাতাল নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা ছিল। কিন্তু আজ সে নিজেই রোগী হয়ে নিজেই বিছানায় পড়ে আছে। নিজেই অদ্ভুদ এক ভয়ে ভীত হয়ে আছে সর্বক্ষণ। কেমন যেন একটা টান অনুভব করলো তন্ময়ের জন্য।
কেন এমন হলো? আমাকে তা জানতে হবে।
আস্তে আস্তে সোহার মানুষটা আর তার পাগল হওয়ার পিছনের কারনটার প্রতি আগ্রহ বাড়তে লাগলো।
তন্ময় ও জেগে থাকতে থাকতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো।
তন্ময় ঘুমিয়ে যাওয়ার পর সোহা ও রুম থেকে বেরিয়ে আসলো। বেরিয়ে এসে দেখে তন্ময়ের মা দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন।
সোহা উনাকে মা ডেকেছে তাই মায়ের মতই উনাকে সম্মান করে। উনার হাত ধরে নিজের রুম এ নিয়ে আসলো সে। উনাকে বিছানায় বসিয়ে বললো - " আপনি কোন চিন্তা করবেন না মা, আমি উনাকে সুস্থ করে তুলবই। এখন আপনি কিছু কাজ করেন আমার জন্য।
- কি কাজ মা? তন্ময়ের মা জিজ্ঞেস করলেন।
- তন্ময়ের ঘরে একটা এলার্ম সিস্টেম এর ব্যবস্থা করেন যাতে প্রয়োজনে ডাকা যায়। আর ডাক্তার, নার্স ২৪ ঘন্টা থাকতে হবে না। আমি এখন থেকে সব মেনেজ করবো। উনাদের বলবেন ঔষদের চার্ট আর কি কি লাগবে আমাকে যেন দিয়ে যান। আর প্রাথমিক চিকিৎসার জ্ঞান আমার আছে, অসুবিধা হবেনা।
- মুখে হাসি নিয়ে তন্ময়ের মা বললেন সব ব্যবস্থা করছি মা আমি এক্ষুনি।
- হুমম, আর এখন আমার বাড়িতে কথা বলার ব্যবস্থা করুন। সবাই আমার জন্য হয়তো পেরেশান হয়ে আছে।
- আমি তো এ কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। তুমি কিছু মনে করনা মা আমি এক্ষুনি কথা বলার ব্যবস্থা করছি।
উনি নিজের মোবাইল টা দিয়ে বললেন কথা বলা শেষ করে রেডি হয়ে নিও,আমরা বাইরে যাবো। মোবাইল ফোন, আর যা যা প্রয়োজন তোমার তা কিনে নিয়ে আসবো।
- ফোন হাতে নিয়ে সোহা বললো মা আমি একটু একা কথা বলতে চাই।
- তুমি কথা বলো, আমি নিচে যাচ্ছি বলে উনি বেরিয়ে গেলেন।
আসার পর থেকে এটা সেটা ঝামেলার জন্য ফোন দিতে পারেনি, কিন্তু বাড়িতে কথা বলার জন্য সোহাও অস্থির হয়ে আছে। সোহার মা ফোন ধরলেন। সোহা তার মা কে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো কেমন আছো মা.? বাড়ির সবাই কেমন আছে?
সোহার মা মেয়ের কন্ঠ শুনেই কেঁদে ফেললেন, -কেমন থাকবো, তোকে ছাড়া কি ভালো থাকতে পারি? আমরা সবাই পাগল হয়ে আছি তুই ফোন যে দিলি না? উনার কান্না দেখে সোহার ও কান্না চলে আসলো, কিন্তু এখন কান্নার সময় নয়। সোহা কান্না সামলে নিয়ে বললো, মা তুমি কাঁদছো যে? সব ঠিক আছে, আমিও ভাল আছি, তুমি বাবার কাছে ফোনটা দাও।
সোহার মা ওর বাবাকে ফোন দিলেন। বাবা ফোন নিয়ে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, মা কাল যাওয়ার পর কি বিয়ে হয়েছে? ঠিকভাবে পৌছেছিস তো? জামাই কেমন রে, নিশ্চয় অনেক ভাল.?
উনার কথা শুনে সোহা কান্না সংবরণ করতে পারছেনা, তাই মুখ চেপে বসে আছে। সোহাকে নিরব দেখে সোহার বাবা জিজ্ঞেস করলেন, - কি হলো সোহা কথা বলছিস না যে? সব কিছু কি ঠিক আছে মা?
- সব ঠিক আছে বাবা, হ্যা উনারা ধুমধাম করে আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে এসে নিয়ে এসেছেন। বিয়েও হয়ে গেছে।
বাবা তুমি চিন্তা করোনা, আমি ভালো আছি।
- আমার মেয়েটার বর আর শশুরবাড়ীর সবাই ভাল হবে জানতাম। তা মা জামাই এর সাথে কথা বলিয়ে দিবি না?
কথা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য সোহা বললো- বাবা আপা কেমন আছে? উনার শশুরবাড়ীর সবাই ভাল তো? - হ্যা মা, মিনহাজ সাহেব অনেক ভাল একটা প্রস্তাব আনছিলেন। সবাই ভাল মানুষ ও খুব সুখে আছে।
- আর বাকিরা সবাই কি ঠিকমত পড়াশোনা করছে? মায়ের অসুখ কি কিছুটা কমেছে?
- ওরা পড়ছে মা। তুই চিন্তা করিস না। আর তোর মায়ের অসুখ এসব বুড়া বয়সে একটু হয়ই চিন্তা করিস না।
- না বাবা মাকে ঠিকমত ঔষদ খাওয়াইও। আর আমি সামনের মাসে মায়ের ভাল চিকিৎসার ব্যবস্থা করবো। - তুই কি শুধু আমাদের চিন্তা করবি? তোর চিন্তা করবি না?
- করছি তো বাবা, করছি বলেই তো এখানে আসলাম।
- তুই কি কাঁদছিস, তুই কি আমাদের কাছে কিছু লুকাচ্ছিস?
- না বাবা তুমি চিন্তা করো না, আমি ভালই আছি। এখন রাখি বাবা পরে কথা বলবো বলে সোহা লাইন কেটে দিল।
এতক্ষণ সোহা কান্না চেপে রাখছিল, কত মিথ্যা বলছে বাবা মা কে। অথচ সোহা কোনদিন বাবা মায়ের সাথে মিথ্যা বলেনি। আজ কিভাবে বলবে তাদের মেয়ে কত বড় সমস্যায় আছে। সোহা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
তন্ময়ের মা একটু আগে দরজায় দাঁড়িয়ে ওর শেষ কথা গুলো শুনলেন। সোহার এভাবে কান্নায় ভেঙ্গে পড়া দেখে নিজে স্থির থাকতে পারলেন না। রুমে ঢুকে সোহাকে জড়িয়ে ধরলেন। সোহাও উনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
তন্ময়ের মা ওকে শান্তনা দিলেন, দেখো মা, সবার জীবন আর ভাগ্য সমান হয়না। দেখ আমাদের তো কোন কিছুর অভাব নেই, কিন্তু আমরা কি সুখী? আমার ছেলের যে এ অবস্থা হলো, এত কিছু করার পরও আমার ছেলে ভাল হচ্ছেনা।
তুমি কেঁদনা মা, আমি সুখে দুঃখে সব বিপদে তোমার পাশে থাকবো। সোহা উনার কাধে মাথা রেখে এসব শুনছিল আর ভাবছিল কত ভাল মানুষ এরা তারপর ও কত কষ্টে আছে। এই মা কে কিভাবে ভুল বুঝবে, আর উনার কথা কিভাবে না শুনে থাকবে.?
সোহা রেডি হয়ে তন্ময়ের মায়ের সাথে মার্কেট এ গেল।
সোহার প্রয়োজনীয় জিনিস, মোবাইল ফোন আর সোহার জন্য কিছু কাপড় কিনে তারপর বাড়ী ফিরে আসলেন।
বাড়ীতে এসে ঢোকার পরই এলিসা দৌড়ে এসে তন্ময়ের মাকে বলল, ম্যাডাম আমার সাথে তাড়াতাড়ি চলুন একটা সমস্যা হয়ে গেছে। এলিসা এ বাড়ির সব কাজ দেখাশুনা করে। সব কাজের লোকের হেড সে, সবসময় সবাইকে কাজ দেওয়া, ঠিকমত কাজ করছে কিনা, তাদের বেতনের ব্যবস্থা সব এলিসা ই করে। এ বাড়ির একজন বিশ্বাসী মানুষ হিসেবে সব কিছুর ভার তন্ময়ের মা এলিসার উপর ছেড়ে দিছেন। তিনি এখন বিষয়টা বুঝতে পেরে সোহাকে বললেন, তুমি উপরে যাও সোহা আমি একটু পরে আসছি।
সোহা বললো - মা আমিও আসি?
- না তোমার আসতে হবে না, তুমি উপরে যাও।তারপর তিনি এলিসার সাথে তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। ওরা চলে যাওয়ার কিছুক্ষন পর সোহা জিনিস পত্র গুলো একটা ঝুঁপের আড়ালে রেখে ওদেরকে অনুসরণ করলো।
উনারা কোথায় যাচ্ছেন? কি সমস্যা হয়েছে, আমাকে সাথে নিয়ে গেলে কি হতো? এসব ভাবতে ভাবতে ওদের পিছু পিছু যেতে লাগলো। দেখল উনারা বাড়ির পেছনে একটা কটেজের দিকে যাচ্ছেন। কিন্তু আনমনা হয়ে চলার কারনে খেয়াল করেনি আরেকটা মেয়ে ওর পিছু পিছু আসছে।ও তাড়াতাড়ি সোহার পাশে এসে বললো, ম্যাম আপনি ওদিকে যেতে পারবেন না। নিষেদ আছে। আপনার এখন উপরে যাওয়ার কথা। সোহার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো, কি রহস্য গিয়ে দেখার আগে তাকে কেউ দেখে ফেলেছে, আর সে খেয়াল করলো বা। এ বাড়িতে কি সবাই সবাইকে চোখে চোখে রাখে। ও আর কিছু না বলে মেয়েটার সাথে উপরে চলে আসলো। মেয়েটা সব জিনিস নিয়ে এসে সোহার রুম এ রাখলো। সোহা রুমে এসে ফ্রেস হয়ে তন্ময়ের রুমে আসলো।
রুমে এসে দেখে তন্ময় কে তার বাবা ঔষদ খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন আর নার্স রা ওকে ধরে রেখেছেন।
সোহা মিনহাজ সাহেবের সামনে এসে বললো- আপনাকে তো বিশ্বাস করেছিলাম আঙ্কেল, আপনি কেন আমার সাথে এমন করলেন?
মিনহাজ সাহেব থমকে গেলেন। তিনি মাথা নিচু করে বললেন- আমাকে ভুল বুঝনা মা। এছাড়া আমার কাছে কোন উপায় ছিল না। তোমাকে দেখে মনে হয়েছে তুমি আমার ছেলেকে ভাল করতে পারবে।
- কেন? আমি ছাড়া কি আর কোন মেয়ে পান নি আপনি?
- ছিল কিন্তু তোমার চেহারার ছিলো না।
- আমার চেহারা! আমি তো কিছু বুঝতে পারছিনা।
- সময় আসলে সব জানবে মা।
সোহাকে দেখার পর থেকে তন্ময়ের পাগলামি আরও বেড়ে গেলো।
ডাক্তার বললেন - 'ওকে এখন ইন্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়াতে হবে, এছাড়া আর কোন উপায় নেই।
সোহা ডাক্তার কে থামিয়ে দিল। জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে উনার? আগে বলুন কেন ইনজেকশন দিতে হবে?
তন্ময়ের বাবা সোহাকে বললেন, তন্ময় সকাল থেকে ঔষদ, খাবার কিচ্ছু খাচ্ছেনা। বলছে কে নাকি তাকে মেরে ফেলবে। এ কথা শুনে সোহা বললো, ঠিক আছে আমি দেখছি কি করা যায়। আপনারা আমাকে একটু সময় একা এখানে থাকতে দিন।
- মিনহাজ সাহেব চোখ মুছে বললেন, - তুমি বেশি রিস্ক নিচ্ছ সোহা, পারবে না তুমি, ডাক্তার ওকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে সেলাইনের মাধ্যমে খাবার দেবে।
- আমার কিছু হববে না আপনারা কোন চিন্তা করবেন না প্লিজ সবাই যান।
মিনহাজ সাহেব সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে আসলেন। সোহা রুমের দরজাটা ভেজিয়ে রেখে তন্ময়ের পাশে বসলো। তা দেখে তন্ময় রাগে আরও ফুঁসতে লাগলো। ওকে দেখলেই তন্ময় রেগে যায়, কিন্তু এখন হাত পা বাধা থাকায় কিছু করতে পারছে না। সোহা এসব বুঝেও না বুঝার ভান করে তন্ময়ের একটা হাত ধরে বললো, খাবার আর ঔষদ না খেলে যে তুমি ভাল হবেনা। সবাই তোমার ভালো চায় তন্ময়। তুমি খাবার টা খাও, দেখবে ভাল হয়ে গেছো।
- রাগে চিৎকার করে উঠলো তন্ময়, " না.... তোমরা সবাই আমাকে মেরে ফেলতে চাও, তোমাদের সবাইকে নীরা পাঠিয়েছে আমাকে মারার জন্য আমি খাবো না। তুমি বেরিয়ে যাও।
- তন্ময় আমি তোমার বউ। বউ কি কখন ও স্বামীকে মেরে ফেলতে চায়?
সোহা দেখলো তন্ময় নিরব হয়ে গেছে। তাই ও আরও পাশে গিয়ে তন্ময়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তারপর খাবার এনে সামনে বসে বললো খাও তন্ময়, আমি তোমাকে নিজহাতে খাইয়ে দেবো।
তন্ময় কিছু বললো না, কিন্তু খাবার খেলো না এটা দেখে সোহা নিজের মুখে খাবার নিয়ে বললো এই দেখো আমি খাচ্ছি, আমার কি কিছু হচ্ছে? নাও এবার লক্ষি ছেলের মতো হা করো।
- খেতে পারি, যদি তুমি আমার হাত পায়ের বাঁধন খুলে দাও।
- দেব, তুমি আগে খাবার আর ঔষদ খাও।আমি তোমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দেব।
তন্ময় আর কিছু না বলে চুপচাপ খেতে থাকলো। খাওয়া শেষে তন্ময় বললো, তুমি আমাকে মারবে না তো? ওরা আমাকে মারতে চায়, তুমি আমাকে বাঁচাবে?
- হ্যা তন্ময় আমি সব সময় তোমাকে পাহারা দেবো, কেউ মারবে না তোমায়, নাও ঔষদ খাও। ঔষদ খাইয়ে সোহা তন্ময়ের হাতের বাধন খুলে দিল। কিন্তু তার একটু পরেই হঠাৎ করে তন্ময় সোহার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সোহাকে কিল ঘুসি মারতে লাগলো আর বলতে লাগলো, - "তুই আমাকে মারতে এসেছিস, তুই ডাইনী, তোকে নীরা পাঠিয়েছে আমাকে মারার জন্য, আমি আজ তোকে মেরে ফেলবো।" সোহা হঠাৎ আক্রমনে আর তন্ময়ের আচরনে অবাক হয়ে গেলো। কিছু বলার ভাষা যেন হারিয়ে ফেলেছে। একটু পর আর সহ্য করতে না পেরে জোরে চিৎকার দিয়ে বিছানাতেই অজ্ঞান হয়ে গেলো। ওর চিৎকার শুনে তন্ময়ের বাবা আর ডাক্তার দৌড়ে আসলেন। ডাক্তার আর নার্স রা তন্ময়কে ধরে ইনজেকশন দিয়ে ধরে রাখলেন। আস্তে আস্তে তন্ময় ও নিস্তেজ হয়ে গেল। আর তন্ময়ের বাবা সোহাকে রুমে নিয়ে গিয়ে মুখে পানি দিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করলেন।
এসময় তন্ময়ের মা তন্ময়ের আর সোহার চিৎকার শুনে তাড়াতাড়ি এসে তন্ময়ের রুমে ঢুকে দেখলেন তন্ময় ঘুমিয়ে গেছে। তাই সোহার রুম এ এসে ঢুকলেন। সোহার এই অবস্থা দেখে চিন্তাক্লিষ্ট মুখে সোহার পাশে বসে তন্ময়ের বাবাকে বললেন - এদিকেও সমস্যা, ওদিকেও সমস্যা হচ্ছে। কিছুতেই নার্স রা ওকে সামলাতে পারছেনা। আমি যে কি করবো? এখানে নিয়ে আসলে সবসময় দেখতে পারতাম, কিন্তু এখানে আনলেও তো ঝামেলা হয়ে যাবে। তখন তো সোহাও একমুহুর্ত থাকবে না। সোহার এসময় জ্ঞান ফিরলো, ও চোখ বন্ধ করে এসব শুনছিল।
তন্ময়ের বাবা বললেন, - লুকিয়ে কি করবো? আজ বা কাল তো জানবেই, এখন জানিয়ে দিলে হয়তো মেয়েটাই একটা সমাধান করে দেবে।
- না আরও কিছুদিন যাক... বলে তিনি থেমে গেলেন।
মিনহাজ সাহেব আর তিনি সোহার জ্ঞান ফিরেছে দেখে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন।
সোহাও তখন কিছু জিজ্ঞেস না করার সিদ্ধান্ত নিল মনে মনে। তারপর উঠে বসলো।
তন্ময়ের মা ওকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললেন, আমি না করেছিলাম মা ওর পাশে একা না থাকতে। এই পর্যন্ত তুমি দুইবার আক্রান্ত হলে। জানিনা ও তোমাকে দেখে এমন করছে কেন। অথচ আমরা ভাবছিলাম ও...
তুমি এখন বিশ্রাম নাও। এলিসাও এ সময় দুধ নিয়ে রুম এ আসলো। তন্ময়ের বাবা মা ওকে বিশ্রাম নেওয়ার কথা বলে চলে গেলেন। সোহা এলিসা কে বসিয়ে দুধের গ্লাস নিয়ে খেতে খেতে ভাবতে লাগলো যে "এ কোন রহস্যের সাগরে ডুব দিলাম, কি ঘটছে এখানে.... "
৩য় কিস্তি...
সোহা পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়লো। তারপর বাগানে গিয়ে বসলো। ভোরের নির্মল, পবিত্র বাতাস আর সবুজ প্রকৃতি সবসময়ই সোহার ভালো লাগে, তাই সোহা সবসময় ভোরে উঠার চেষ্টা করে। আর ভোরে মানুষের ব্রেইন ও ফ্রেস থাকে।সোহা বসে ভাবতে লাগলো এখানে আসার পর কি কি বিষয় তার কাছে রহস্যময় মনে হয়েছে।
সবগুলা ক্রমান্বয়ে মনে মনে চার্ট করতে লাগলো-
১. দেশে বিদেশে এত মেয়ে থাকতে সোহাকে এখানে নিয়ে আসা এবং সোহার চেহারার সাথে কোনকিছুর সম্পর্ক।
২. সোহাকে দেখলে তন্ময় কখনও নিরব থাকে, কখনও রাগে ভয়ংকর হয়ে উঠে। এবং সোহা খেয়াল করেছে ঔষদ খাওয়ার পরই তন্ময় ভয়ংকর হয়ে উঠে।
৩. এ বাড়ির মালিক -মালকিন থেকে শুরু করে কাজের লোক গুলাও পর্যন্ত আর ও একটা বিষয় লুকিয়েছে। যে বাড়ির পিছনের কটেজে থাকে।
৪. তন্ময় সবসময় নীরা নীরা ডাকে, কে এই নীরা?
৫. এবং সর্বশেষ তন্ময়ের পাগল হওয়ার বিষয়।
প্রথম গুলোর রহস্য উন্মোচন করলে শেষটা বেরিয়ে আসবে।
আরও একটা বিষয়, সবাই বললো তন্ময় বিবাহিত, কিন্তু ওর বউর কোন ছবি বা বিয়ের ছবি এ বাড়ির কোথাও দেখেনি।
প্রথম থেকে শুরু করলে ওকে আজ কটেজে যেতে হবে যেভাবে হোক। আর ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন চেক করতে হবে কি ধরনের ঔষদ ওকে দেওয়া হয়।
সোহা দেখলো এখন সকাল ৭টা বাজে, কেউ ঘুম থেকে উঠার আগে তাকে কটেজে যেতে হবে। সোহা তাড়াতাড়ি কটেজের দিকে রওয়ানা দিল।
কটেজের চারপাশ ঘুরেও কোন দরজা জানালা খোলা পেল না। এত সকাল এখানে কেউ উঠে নি। ও আবার জানালা গুলো দেখার চেষ্টা করলো, হয়তো খোলা থাকতে পারে। অবশেষে একটা জানালা খোলা পেয়ে সেদিক দিয়ে ঢুকলো। ও ঢুকার পরে একটা দিক থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনে সেদিকে এগিয়ে গেলো। সেখানে গিয়ে দেখলো একজন ন্যানি একটা বাচ্চার কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন কিন্তু পারছেন না। ও এগিয়ে গিয়ে বললো, - দিন আমার কাছে দিন। সোহাকে দেখে ন্যানি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। সোহা উনার কাছ থেকে বাচ্চা টাকে কোলে নিল, ওর কোলে যাওয়ার পর ওর মুখ দেখে বাচ্চাটা কান্না থামিয়ে দিল দেখে সোহাও অবাক হয়ে গেলো।
- ম্যাম আপনি এখানে এত সকাল কিভাবে এলেন? আপনাকে এখানকার কথা কে বললো?
- কেউ বলেনি, কিন্তু আপনি আমাকে চিনেন কিভাবে?
- চিনি তো আপনি ছোট স্যার এর স্ত্রী। আপনার এখানে আসা ম্যাডাম জানলে রাগ করবেন, আপনি যান।
- আমি যাবো, তার আগে বলেন ম্যাডাম কেন রাগ করবেন? আর এই বাচ্চা টা কার?
- আমি এসব বলতে পারবো না। ম্যাডামের নিষেদ আছে। কিন্তু বাচ্চা টা আপনার কোলে গিয়েই দেখি কান্না থামিয়ে দিল। আর আমরা ওকে এক মুহুর্তের জন্য থামাতে পারিনা।
- এটাই তো প্রশ্ন, প্লিজ আপনি বলেন, এ বাচ্চা কার? আর আমার কোলে এসে কেন শান্ত হলো?
- আপনার চেহারার সাথে এ বাড়ির ছোট বউ এর হুবহু মিল। আর এই বাচ্চা ছোট স্যার এর ম্যাম।
সোহা অবাক হয়ে গেলো এসব কি শুনছে ও..?
কিছুক্ষন পর সোহা বললো ঠিক আছে, ওহ আচ্ছা আপনার নাম কি?
- জ্বি আমি জুলি।
- আপনি কি বাংলাদেশি?
- জ্বি আমাকে ম্যাডাম বাচ্চা দেখার জন্য দেশ থেকে আনিয়েছেন।
- ওকে জুলি আপু, আমি আপনাকে আপু বলেই ডাকবো প্লিজ না করবেন না।
আর যতদিন না আপনার ম্যাডাম আমাকে বেবিটার কথা বলছেন আমি প্রতিদিন সকালে আসবো। আপনি উনাকে কিছু বলবেন না।
- ওকে ম্যাম আপনি এখন যান। আমি সকালে দরজা খোলে রাখবো তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করবেন কেউ যেন না দেখে।
সোহা ন্যানিকে কথা দিয়ে তাড়াতাড়ি কটেজ থেকে বেরিয়ে আসলো।
সোহা তার রুমে এসে ভাবলো, সমস্যার সমাধান হওয়া দূরে থাক আরও জট পাকিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি হাল ছাড়বো না।
একটু পরে এলিসা নাস্তা নিয়ে রুমে আসলো।
- আপনি কোথায় ছিলেন ম্যাম আগে এসে দেখে গেলাম আপনাকে পেলাম না।
সোহা এলিসা কে ধরে এনে পাশে বসিয়ে বললো, এলিসা, আসার পরেই তোমাকে আমার ভালো মনে হয়েছে। তুমি কি আমাকে বোনের মতো দেখে হেল্প করতে পারো না? তুমি কি চাও একটা মেয়ে এখানে সব রহস্যের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকুক?
- কি বলছেন ম্যাম? আমি এসব কোন সময় চাইনা। কি হেল্প চান বলুন।
- তাহলে বলো তুমি তো এ বাড়ির ভাল চাও, চাও তো?
যদি চাও আর আমাকে বিশ্বাস করো তাহলে আমি যা বলবো তা করবে বলো।
এলিসা একটু সময় চুপ থেকে বললো, ঠিক আছে ম্যাম, আমার সাধ্য মত সাহায্য করবো।
- ওকে এখন বলো এ বাড়িতে যে ডাক্তার রাখা হয়েছে উনারা কি আগেও ছিলেন? আর উনারা সব কি স্যার মানে মিনহাজ সাহেবের পরিচিত?
- আপনার আসার ২/৩ দিন আগে নতুন একজন ডাক্তার এসেছেন বদলি হয়ে। কিন্তু উনি আসার পর থেকে স্যার বেশি পাগলামি শুরু করেছেন।
- আচ্ছা নীরা কি তন্ময়ের স্ত্রী ছিল?
- জ্বি।
- ওর কি কোন ছবি আমাকে দেখাবে?
এলিসা বললো, ম্যাম যেদিন ছোট ম্যাম বাড়ি থেকে চলে যান, সেদিন স্যার ও পিছু পিছু গিয়েছিলেন। আসার পর সব ছবি কোথায় যে গায়েব করলেন আর ধীরে ধীরে উনার পাগলামী শুরু হলো।
সোহা এলিসার হাত ধরে বললো এলিসা, ঔষদে কোন সমস্যা আছে, আমার সাথে অন্য কোন মানসিক ডাক্তারের কাছে তোমাকে যেতে হবে। আমি তো এখানের কাউকে চিনিনা।
এলিসা অবাক হয়ে বললো কি বলছেন ম্যাম আপনি এসব?
- হ্যা এলিসা এটাই ঠিক। তুমি মাকে নিয়ে আসো, আমি তন্ময়ের রুম এ যাচ্ছি।
সোহা তন্ময়ের রুম এ ঢুকে দেখলো নার্স তন্ময় কে ঔষদ খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। তন্ময় খেতে চাচ্ছে না।
সোহা নার্স কে বললো, -আপনি ঔষদ খাওয়াতে হবেনা, আপনি সরুন আর এখানে নতুন ডাক্তার কে এসেছেন?
আমি বলে একজন এগিয়ে আসলেন।
সোহা বললো, আপনারা সবসময় এখানে থাকেন?
- হ্যা নিচে আমাদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
- আচ্ছা আপনারা এখন নিচে যান। আমি উনাকে ঔষদ খাওয়াবো। এ কথা শুনে নতুন ডাক্তার বাধা দিয়ে বললো, না ম্যাম এক্ষুণি উনাকে ঔষদ খাওয়াতে হবে।
- আমি সেটা দেখবো, আপনাকে চিন্তা করতে হবে না।
ওদের চেঁচামেচি শুনে তন্ময়ের মা এসে ঢুকলেন।
ডাক্তার এগিয়ে গিয়ে বললো ম্যাম ঔষদ খাওয়াতে দিচ্ছেন না ম্যাডাম।
ডাক্তার এমন ভাবে বলছেন যেন ঔষদ খাওয়ানো এখন তার জন্য জীবন মরনের প্রশ্ন।
সোহা বললো মা আমি বলছি আমি পরে খাওয়াচ্ছি, না করিনি। বলছি উনারা যেন নিচে গিয়ে বিশ্রাম করেন।
এ কথা শুনে তন্ময়ের মা ও বললেন, ঠিক আছে আপনারা নিচে যান।
যাওয়ার সময় ডাক্তার সোহার দিকে এমন ভাবে তাকালো যেন সোহাকে পারলে এক্ষুণি চিবিয়ে খায়।
সোহা ও বুঝে ফেললো ডাক্তারের চাহুনী তে, যে এই ডাক্তারের মধ্যে কোন গড়বড় আছে।
তন্ময়ের মা সোহার পাশে এসে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে সোহা? তুমি নাকি ঔষদ ডাক্তার সবকিছুতে সন্দেহ করছো?
- মা আপনি কি আমাকে বিশ্বাস করেন?
- অবশ্যই মা, এই কয়দিনের ব্যবহারে আমি তোমাকে চিনে ফেলেছি তুমি কেমন মেয়ে।
- তাহলে আমি এলিসা কে নিয়ে বাইরে যাচ্ছি, আপনি তন্ময়ের খেয়াল রাখবেন। আর কোন ঔষদ খাওয়াতে দেবেন না।
এতক্ষণ থেকে তন্ময় সোহার দিকে নিরবে তাকিয়ে ছিল, কোন পাগলামি করেনি। সোহা ওর পাশে গিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে বললো, মা দোয়া করবেন আজ আপনার ছেলের একটা রহস্য উন্মোচন করেছি। এখন যেন আরেকটা করতে পারি।
সোহা প্রেসক্রিপশন নিয়ে এলিসাকে সাথে নিয়ে শহরের নামকরা একজন ডাক্তারের কাছে গেল।
সোহা ওইখানে গিয়ে ডাক্তার কে প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো দেখুন তো এই প্রেসক্রিপশন এর সব ঔষদ একজন মানসিক রুগিকে দেওয়া ঠিক হচ্ছে কিনা?
ডাক্তার রোগী আর ঔষদের নাম দেখে চমকে গেলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন,
- রোগী আপনার কি হয়?
- জ্বি আমার স্বামী, সোহা বাধ্য হয়ে উত্তর দিল। যতই হোক চুক্তি বিয়েতে তো স্বামী তার।
- যে ডাক্তার চিকিৎসা করছেন উনারা কি আপনার শশুরের পরিচিত? ডাক্তার সাহেব আবার জিজ্ঞাসা করলেন।
- একজন পরিচিত, অন্যজন কে বদলে দেওয়া হয়েছে।
কেন ডাক্তার? কোন সমস্যা?
- আপনি কি উনার বিশ্বস্ত ব্যক্তি?
- জ্বি আপনি নিশ্চিন্তভাবে বলেন।
ডাক্তার সাহেব নড়েচড়ে বসলেন, তারপর ২টা ঔষদের নাম দেখিয়ে বললেন, এই ঔষদের মধ্যে যে ধরনের পদার্থ রয়েছে তার মধ্য একটি একজন মানুষকে ভয়ংকর, পাগল আর স্মৃতিশক্তি বিনষ্ট করে দেওয়ার জন্য যতেষ্ট। আর ওপর টি তে এমন এক ধরনের ভাইরাস যা একজন মানুষের শরীরের কোষগুলো নষ্ট করে দিয়ে মানুষকে মেরে ফেলে, যা অত্যন্ত ধীর প্রতিক্রিয়া। ১০ বছরের ভিতরও যা ধরা পড়েনা। এই ঔষদ গুলো যে দিয়েছে আমার মনে হয় সে অত্যধিক চালাক এবং এই ছেলেটিকে জীবন্ত ধ্বংস করে দিতে চায়।
এসব কথা শুনে সোহা বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। ও তো ভাবছিল কোন গড়বড় এখন তো দেখা যায় মারাত্মক ঘটনা গঠছে এখানে।
সোহা বললো ডাক্তার সাহেব এখন কি করা যায়? আপনি তো ডাক্তার, প্লিজ আপনি একটা পদ্ধতি খুজে বের করুন।
ডাক্তার বললেন আগে ঔষদ গুলা খাওয়ানো বন্ধ করতে হবে, তারপর রোগীর অবস্থা বিবেচনা করে ঔষদ দিতে হবে।
ডাক্তার কে সোহা বললো, আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই, যদি আপনি বিষয়টা গোপন রাখেন। আপনি তো মিনহাজ চৌধুরীকে চিনেন উনার জন্য প্লিজ আমাদের হেল্প করেন।
-জ্বি বলুন?
- মিনহাজ চৌধরীর বাড়িতে একটা বড় রহস্য আছে মনে হয়। আর তা উনার ছেলেকে নিয়ে, তাই কেউ পরিকল্পনা করে এরকম করছে। আপনি যদি উনার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন কৃতজ্ঞ থাকবো।
- দেখুন, আমার কাজ রোগীর চিকিৎসা করা, রহস্য নয়। আর রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হলে রোগীকে দেখতে হবে।
- আমি নিয়ে আসার চেষ্টা করবো। আপনি এখন লিখিতভাবে এই ঔষদ গুলার ক্ষতিকর দিক বর্ণনা করুন এবং ঔষদের বিকল্প ঔষদের ব্যবস্থা করুন।
ডাক্তার ঔষদের বাতিলপত্র ও ক্ষতিকর দিক লিখে নতুন ঔষদের ব্যবস্থা করলেন।
সব ব্যবস্থা করে সোহা বাড়ি ফিরলো। কিন্তু কটেজের দিকে চিৎকারের আওয়াজ শুনে দৌড়ে ওখানে গেলো। গিয়ে দেখে বাচ্চা টাকে সামলানো যাচ্ছে না। তন্ময়ের বাবা মা দুজনই এখানে আছেন। সোহা কোনদিকে না তাকিয়ে গিয়ে বাচ্চা টাকে তন্ময়ের মায়ের কোল থেকে নিল। তন্ময়ের বাবা মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন তুমি এখানে? আর বাচ্চাটার কথা কিভাবে জানো?
ততক্ষনে সোহা বাচ্চার কান্না থামিয়ে বাচ্চাকে ফিডারের দুধ খাওয়াতে লাগলো। ও দেখলো বাচ্চা টা ৩/৪ মাস বয়সের একটা ছেলে। এত ছোট বাচ্চাকে কেউ রেখে যায়?
সোহা উত্তর দাও? আবার তন্ময়ের মা জিজ্ঞেস করলেন।
- কেন মা? আপনারা কি ভাবছিলেন লুকিয়ে রাখতে পারবেন? সেদিন এলিসার সাথে আপনার কথা শুনে, পরে আবার আঙ্কেলের সাথে কথা শুনে সন্দেহ জাগে, তাই সেটা খুজতে এসে দেখি বাচ্চা। কেন আপনারা আমার কাছ থেকে এসব লুকালেন?
আমতা আমতা করে তন্ময়ের মা বললেন, যদি তুমি চলে যাও তাই বলিনি মা। কিন্তু পরে অবশ্যই বলতাম। আমরা ভুলে গিয়েছিলাম তুমি সোহা। তুমি সব রহস্যের কিনারা করো।
- আমার জীবন তো একটা বিবেকের গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ মা, না পারছি সেটা ভাঙ্গতে, না পারছি পেরিয়ে যেতে।
আর জেনেই যখন গেছি আজ থেকে ছেলেটা আমার কাছে বাড়িতে থাকবে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তন্ময়ের মা বললেন, "তুমি আমাকে অনেক বড় বিপদ থেকে রক্ষা করলে মা।" এমনতি ছেলেটাকে নিয়ে কত চিন্তায় আছি।
চলুন বাড়িতে আপনাদের সাথে কিছু কথা আছে আমার। উনারা নিরবে সোহার পিছু নিলেন।
ঘরে এসে সোহা উনাদেরকে সব জানাল। সব শুনে উনারা স্তব্ধ হয়ে গেলেন।
তন্ময়ের বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কে করতে পারে এসব? আমার ছেলের সাথে কার এত শত্রুতা?
- সেটা তো আমি জানিনা আঙ্কেল। সেটা জানতে হলে আমাদের প্ল্যানমত কাজ করতে হবে।
- ঠিক আছে মা আমাকে কি করতে হবে বলো। তুমি আমাকে বাবা ডাকতে পারো না? এত ঘৃণা করো আমায়?
- ঘৃণা কেন করবো? আমি কাউকে নিজের ভাগ্যের জন্য দোষ দেই না। যতটুকু লিখা আছে ততটুকুই হবে। আর চুক্তিতে তো কোথায়ও লিখা হয়নি যে চুক্তি বিয়ের শশুর শাশুড়ি কে বাবা মা ডাকতে হবে।
এ কথা শুনে মিনহাজ সাহেব মাথা নিচু করে ফেললেন।
উনার কাঁধে হাত রাখলো সোহা , " এখন আমাদের আবেগী হওয়ার সময় নয় আঙ্কেল আমাদের আগে তন্ময়ের জীবন বাচাতে হবে। আপনি তন্ময়ের রুমে সিসি টিভি ক্যামেরা ফিট করুন। আর ডাক্তার দের বলে দিবেন এখন থেকে ঔষদ আমি খাওয়াবো।
- "ওকে আমি আজই ব্যবস্থা করছি" বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন।
বিকালের দিকে মিনহাজ সাহেব লাইন ঠিক করবেন বলে মিস্ত্রী এনে লুকিয়ে সিসি টিভি ক্যামেরা ফিট করলেন। আর ডাক্তার দের বললেন , সোহা আজ থেকে ঔষদ খাওয়াবে।
সোহা রাত্রে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে তন্ময়ের রুমে গেলো। সে বাচ্চাটার প্রতি তন্ময়ের প্রতিক্রিয়া জানতে চায়।
তন্ময় বাচ্চাকে দেখে প্রথমে রাগে ফুঁসতে লাগলো, পরে কান্না শুরু করলো। সোহা বাচ্চা কে এলিসার কোলে দিয়ে তন্ময়ের পাশে বসে বললো, তন্ময় বাচ্চাটা তোমার, বাচ্চাটা আমাদের। তোমার কিছু মনে পড়ে?
মনে করো তুমি পাগল না, তুমি ভাল একজন ডাক্তার। কথা বলো তন্ময়, কে তোমাকে মারতে চায়? বলো আমাকে?
হঠাৎ তন্ময় সোহাকে জড়িয়ে ধরে বলতে শুরু করলো তুমি আমাকে বাঁচাও, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে, বাচ্চাকে মেরে ফেলবে, ওরা সবাইকে মারবে। ওই হাসপাতালে সবাই মরবে।
- কোন হাসপাতাল? কারা মারবে? বলো তন্ময় বলো.? কিন্তু তন্ময় আর কিছু বলতে পারলো না মাথার চুল খামছে ধরে অজ্ঞান হয়ে গেলো।
সোহা ওকে যত্ন করে শুইয়ে দিল। দুইবেলা থেকে সোহা ঔষদ খাওয়ানো বন্ধ করে দিছিলো, তাই অজ্ঞান হয়ে গেছে ভেবে সোহা জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করলো। ওইদিকে ঐ ডাক্তার লুকিয়ে সব কিছু দেখছিল।
সোহা তন্ময়কে ঔষদ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো। ততক্ষণে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।
ও রুমে এসে চিন্তায় ডুবে গেল, কে এমন করছে? কাউকে তো এমনি সন্দেহ করা যায়না।
ওইদিকে তন্ময়ের রুমে ঘটছে আরেক ঘটনা। ডাক্তার রুমের ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ডুকে তন্ময়কে ঔষদের বদলে ইনজেশন পুস করে চলে গেলো রুম থেকে।
সোহা এমনিতে ভোরে ঘুম থেকে উঠে, আজ বাচ্চাটার জন্য আরও আগে উঠে গেলো। বাচ্চা কে খাইয়ে, ময়লা পরিস্কার করে নামাজ শেষ করলো। তারপর বাচ্চাকে নিয়ে তন্ময়ের রুমে রওয়ানা হলো।
সোহা ভাবছিল তন্ময় এখনও ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু তখন যে তার আর বাচ্চাটার জন্য তন্ময়ের রুমে মরন ফাঁদ অপেক্ষা করছে সোহা তা ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি।
সোহা রুমে ঢুকামাত্র তন্ময় দৌড়ে এসে বাচ্চাটাকে কেড়ে নিতে গেলো ওর একহাতে বড় চাকু, মুখের ভঙ্গি ভয়ংকর।
সোহা এই দৃশ্য দেখে আতঙ্কে এত জোরে চিৎকার দিলো যে তন্ময় ও এক মুহুর্তের জন্য থেমে গেলো।
সোহার জ্ঞান বুদ্ধি এই মুহুর্তে লোপ পেলো। ও হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু তন্ময়ের আসা দেখে সোহা ভাবলো এখন ভয় আমাকে ভয় পেলে চলবে না, এখন শক্তি নয় বুদ্ধি দিয়ে কাজ করতে হবে।। ও দৌড়ে রুম থেকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু তার আগে দরজার সামনে তন্ময় এসে দাঁড়ালো। তন্ময় সোহার দিকে আসছে দেখে সোহা পিছু হঠতে লাগলো। তখন মনে পড়লো এলার্ম বাজাতে হবে, ও সুইচ বোর্ডের দিকে দৌড় দিল। কোনমতে এলার্ম বাজাল, তন্ময় পিছে পিছে আসছে দেখে আবার দৌড় দিলো। তন্ময় সোহার দিকে আসছে আর বলছে, - ডাইনী বাচ্চাটা আমার কাছে দিয়ে দে, তুই আমাকে মারতে চাস, বাচ্চাটাও আমাকে মারতে চায়, আমার কাছে দে, আমি ওকে আগে মারবো, দিয়ে দে নইলে তোকে আগে মারবো। সোহা তন্ময়ের এই অবস্থা দেখে বাচ্চা টাকে আকড়ে ধরে দৌড়াতে লাগলো আর বাঁচাও বাচাঁও বলে চিৎকার করতে লাগলো। সোহার চিৎকার, বাচ্চার কান্না আর তন্ময়ের ভয়ংকর গর্জন সব মিলিয়ে ঘরের ভিতর এক নারকীয় অবস্থা। হঠাৎ পিছন থেকে সোহার মাথায় তন্ময় টব ছুড়ে মারলো। সোহা বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরে "হে আল্লাহ! তুমি এই নিষ্পাপ বাচ্চাকে রক্ষা করো" বলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।
একটানা তিন ঘন্টা পর সোহার জ্ঞান ফিরল। প্রথমে বুঝার চেষ্টা করলো কোথায় আছে সে। দেখলো তন্ময়ের মা পাশে বসে আছেন, ডাক্তার, এলিসা ও রুমে আছে।
"বাচ্চা...., আমার ছেলে কই " বলে উঠে বসার চেষ্টা করলো।
- তন্ময়ের মা বললেন, তোমাকে উঠতে হবেনা মা। তুমি মারাত্মক আহত। তুমি চিন্তা করোনা বাচ্চাটার কিছু হয়নি। ভাগ্য ভাল আমরা সময়মত এসে গিয়েছিলাম, নাহলে বাচ্চা সহ তুমিও মারা যেতে তন্ময়ের হাতে।
- মা তন্ময় কেমন আছে?
- এখন ভাল আছে, ওকে বেধে রাখা হয়েছে। এখন ঘুমুচ্ছে। কেন যে হঠাৎ এত উন্মাদ হয়ে গেল বুঝলাম না।
মাথা ভারী লাগছে দেখে মাথায় হাত দিয়ে দেখলো ব্যান্ডেজ বাধা।
- কি হয়েছে মা? ব্যান্ডেজ কেন আমার মাথায়.?
- সোহা তোমার মাথায় তন্ময় ফুলের টব ছুড়ে মেরেছিল। তাই মাথার অনেক জায়গা ফেটে গেছে, অনেক রক্ত গেছে তোমার শরীর থেকে তোমাকে এখন বিশ্রাম করতে হবে।
বিছানায় শুয়ে সোহা ভাবলো, হঠাৎ করে কেন এমন করলো তন্ময়। রাতে তো ও ভালই ছিল। আর বাচ্চা, ওই বাচ্চাটার প্রতি ওর এত বিদ্বেষ কেন?
মনের অজান্তেই বাচ্চাটার প্রতি একটা টান অনুভব করলো।
বাচ্চার কথা আবার মনে পড়তেই সোহা মা কে বলল, " মা ছেলে টাকে আমার কাছে এনে দিন আমি ওকে দেখবো। আচ্ছা মা এখন ও তো বললেন না ওর নাম কি ?"
তন্ময়ের মা বললেন, - যেদিন বাচ্চাটার জন্ম হয় সেদিন নীরা ওকে হসপিটালে রেখে চলে যায়, এরপর থেকে তন্ময় ওর দিকে তাকালেই কেমন যেন গম্ভীর হয়ে যেত। ওকে দেখলেই রেগে যেত, মাঝে মাঝে কান্না করতো। তাই আমরা মনে করেছি ওই নীরা আর বাচ্চাটাই আমার ছেলের পাগল হওয়ার কারন। তন্ময়ের চোখের আড়ালে রাখার জন্য আমরা কটেজে একজন ন্যানির তত্তাবধানে রেখে দেই। এরপর থেকে তন্ময়ের পাগলামির জন্য আমরা এতটা ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে নাম রাখার কথা আর মনেই আসেনি।
সোহা এসব শুনে বললো, এতে তো বাচ্চার কোন দোষ নেই, ও তো নিষ্পাপ একটা ছেলে। এটা ঠিক নয় মা।
এ কথা শুনে তিনি মাথা নিচু করে ফেললেন।
সোহা আবার বললো, তন্ময়ের পাগল হওয়ার পিছনে অন্যকোন কারন আছে মা। আপনি আঙ্কেল কে নিয়ে আসুন, আমার কিছু কথা আছে। আর বাচ্চা টাকেও নিয়ে আসবেন।
তন্ময়ের মা সবাইকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
একটু পরে মিনহাজ সাহেব আরর তন্ময়ের মা বাচ্চাকে নিয়ে ঘরে আসলেন।
সোহা উনার কাছ থেকে বাচ্চা টাকে কোলে নিয়ে বললো, আঙ্কেল কাল রাতের সিসিটিভি ফোটেজ টা তন্ময়ের রুম থেকে নিয়ে আসেন।
- কেন সোহা? কোন সমস্যা?
- আঙ্কেল আমার মনে হয় কাল রাত্রে কিছু একটা ঘটেছিল। তাই তন্ময় এত উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। কারন কাল দিনের বেলা থেকে আমিই ঔষদ খাওয়াচ্ছি তন্ময়কে।
- কি বলছো এসব..!? আচ্ছা ঠিক আছে আমি এক্ষুণি নিয়ে আসছি।
সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো রাত্রে সেই ডাক্তার তন্ময়কে ইনজেকশন দিচ্ছে, তারপর ওর ঔষদের মধ্যে কি ঘাটাঘাটি করছে।
এটা দেখে সোহা বললো আমি আগে থেকেই ওকে সন্দেহ করছিলাম। ও কিছু একটা সয়তানি কাজ করছে ভাবছিলাম। আপনি এক্ষুনি পুলিশ কে ফোন করুন, আর এই নিন কার্ড, এই ডাক্তারকে তন্ময়ের চিকিৎসার জন্য আনুন। উনি অনেক ভাল আর বিশ্বাসী মানুষ।
মিনহাজ সাহেব ফেল ফেল করে তাকিয়ে রইলেন ওর মুখের দিকে।
- তোমার ঋন আমরা কোনদিন শোধ করতে পারবো না মা। তুমি আমাদের জন্য এত কিছু করছো।
- আঙ্কেল, এটা আমার কর্তব্য। তাছাড়া আমি এই কাজের জন্য চুক্তির মাধ্যমে টাকা নিয়েছি।
- মা তুমি আমাকে ক্ষমা করো।
- প্লিজ আঙ্কেল, আপনি এখন এসব বাদ দেন। তাড়াতাড়ি পুলিশ আর ডাক্তার কে ফোন করে আসতে বলুন।
চোখ মুছতে মুছতে মিনহাজ সাহেব বেরিয়ে গেলেন।
আধা ঘন্টার ভিতরে পুলিশ আসলো। ডাক্তার ও এমন সময় আসলেন। মিনহাজ সাহেব বললেন আগে আমার সাথে চলুন ওই ডাক্তারকে এরেস্ট করেন যাতে পালাতে না পারে। পুলিশ নতুনন ডাক্তারকে এরেস্ট করলো।
৪র্থ কিস্তি...
মিনহাজ সাহেব ডাক্তারকে নিয়ে তন্ময়ের রুমে গেলেন। ডাক্তার তন্ময়ের ঔষদের মধ্যে বিষাক্ত সিডাকটিভ, ভয়াবহ ক্যারসিনোজেন পেলেন। পুলিশ ও নতুন ডাক্তারের রুম সার্চ করে সেই উপাদান গুলো এবং রাতের সেই ইনজেকশন সিরিন্জ খুজে পেল যেটাতে সিডাকটিভ সহ ভয়ংকর উন্মাদের ঔষদ মিশিয়ে তন্ময়কে ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল। সার্চ করে আরও পাওয়া গেল নীরার একটা কার্ড, কিছু ভাইরাস জাতীয় ঔষদের লিস্ট এবং তন্ময়ের ঔষদের লিস্ট। ডাক্তার তন্ময়কে পরীক্ষা করলেন, ঔষদ প্রেসক্রিপশন দেখলেন। তারপর পুলিশের হাতে তন্ময়ের রুমে পাওয়া উপাদান গুলো দিয়ে বললেন, তন্ময় পাগল হয়নি, খুব প্ল্যান করে তন্ময়কে ধীরে ধীরে পাগল করা হয়েছে। খুব ধীরে ধীরে তন্ময়কে সেই ঔষদ দেওয়া হচ্ছিল, পাশাপাশি শরীরে ঢুকানো হচ্ছিল বিষাক্ত ক্যারোসিনোজেন। যা ১০ বছরে একজন মানুষ কে ক্যান্সারে আক্রান্ত করে মেরে ফেলার একটা ধীর পক্রিয়া।একথা শুনে সোহা ও বাকি সবাই শিউরে উঠলো।
কে এমন কাজ করলো? কার সাথে তন্ময়ের এত শত্রুতা? এসব কি নীরা করছে? কিন্তু কেন..?
এসব শুনে, সিসি ক্যামেরা ফুটেজ নিয়ে, একটা রিপোর্ট লিখে পুলিশ নতুন ডাক্তার কে নিয়ে চলে গেলো।
- ডাক্তার, আমার ছেলে কি ভালো হবেনা, তন্ময়ের মা কেঁদে ফেললেন।
- কোন চিন্তা করবেন না। এই ঔষদ বেশিদিন দেওয়া হয়নি, সঠিক চিকিৎসা আর নিবিড় পর্যবেক্ষণ পেলে তন্ময় তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠবে। আপনাদের একটু বেশি সতর্ক থাকতে হবে।
সবাই রুম থেকে বেরিয়ে আসার পর সোহা গিয়ে তন্ময়ের পাশে বসলো। তন্ময় তখন জেগে উঠেছে তন্ময় সোহার মুখের দিকে নিরবে চেয়ে আছে। কি মায়াবী মুখ, কত ভাল মানুষ মনে হচ্ছে।
ভিতর থেকে কে যেন সোহাকে বলে উঠলো তন্ময়কে বাঁচাতে হবে, ভালো করতে হবে, ওর পাশে থাকতে হবে। কিন্তু একরাশ অভিমান ও কাজ করলো তন্ময়ের উপর।
ও কেন আমাকে মারতে চায়, ডাইনী বলে.? আমার সাথে ওর কিসের শত্রুতা?
তন্ময় সোহার দিকে তাকিয়ে বললো, তোমার মাথায় কি হয়েছে? তুমি কথা বলছো না কেন?
- তুমি আমাকে মেরেছো, এখন আবার জিজ্ঞেস করছো?
- আমি তোমাকে কেন মারবো?
- মনে পড়ছে না তোমার? কি হয়ে যায় তোমার? কে মারবে তোমায়, কেন এসব করো মনে হচ্ছে কিছু?
- না, আমার কিচ্ছু মনে পড়েনা। উফ্, কি হয়েছে আমার। আমি আমি...
বলে তন্ময় মাথা খামচে ধরলো।
- থাক কিছু মনে করা লাগবে না। এখন বলো তুমি আর আমাকে দেখে রাগবে না তো?
- না, কিন্তু তুমি কে?
- আমি! আমি তোমার বউ!
- বউ! আমি তোমাকে বিয়ে করছি..!?
সোহা কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো, হুমম। তুমি ভুলে গেছো। এখন এসব বাদ দেও। তুমি শুয়ে থাকো, আস্তে আস্তে সব মনে পড়বে। আমি আসছি একটু পরে।
কিছুক্ষন পরে সোহা বাচ্চা টা কে নিয়ে রুমে ঢুকলো, " এই দেখো আমাদের ছেলে, ওর নাম আমি রাখবো শান। ও আমাদের শান, সম্পদ। বলে সোহা তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তন্ময় তখন রাগে ফুঁসছে, ও চিৎকার করে বললো, যাও ওকে নিয়ে বেরিয়ে যাও। আমি ওকে সহ্য করতে পারছি না। তারপর বালিশে মাথা চেপে ধরলো।
সোহা এসব দেখে নিরবে বেরিয়ে গিয়ে বাচ্চা টাকে রেখে আসলো।
তন্ময় শুয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। সোহা তন্ময়ের পিঠে হাত রেখে বললো, ঠিক আছে আমি ওকে আর তোমার কাছে আনবো না। তুমি শান্ত হও, আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি তুমি ঘুমাও।
সোহা তন্ময়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো আর তন্ময় সেই পরশে ঘুমিয়ে পড়লো।
পরদিন সকাল বেলা থেকে তন্ময়ের খুব বেশি জ্বর হলো। জ্বরের ঘোরে বেহুশ হয়ে পড়ে রয়েছে।
ডাক্তার এসে দেখে বললেন, এতদিন সিডাকটিভ ওর শরীরে দেওয়া হয়েছে। হঠাৎ করে তা বন্ধ করে দেওয়ায় এই অবস্থা। তিনি ইনজেকশন আর ঔষদ লিখে দিলেন।
- এই ইনজেকশন গুলো দিলে ঔষদের প্রতিক্রিয়া কেটে যাবে আর নিয়মিত ঔষদ গুলো ও খাওয়াতে হবে। আশা করি তন্ময় পুরো সুস্থ হয়ে উঠবে।
একটানা ১৫ দিন জমে মানুষে টেনে তারপর তন্ময় কিছুটা সুস্থ হলো। কিন্তু মাথা পুরোপুরিভাবে কাজ করে না। সোহা এই কয়দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে তন্ময় কে সুস্থ করে তোলার জন্য।
তন্ময় সুস্থ হওয়ার পর সবার সাথে কথা বলছে, সবাইকে চিনেছে। কিন্তু এখনও মনে করতে পারছে না কেন নীরা তাকে ছেড়ে চলে গেল। কাদের সাথে কি বিষয় নিয়ে শত্রুতা মনে করার চেষ্টা করলেই মাথাটা কেমন করে উঠে। এবং এখন ও শান কে ওর কাছ থেকে আড়ালে রাখা হয়।
সোহা আজ সারাদিন থেকে তন্ময়ের রুমে আসেনি। ও ভাবছে, এটা চুক্তি বিয়ে কোন বৈধ সম্পর্ক নয়।। যত সামনে যাবো ততই জড়িয়ে যাবো। কিন্তু তাও কি জড়ায়নি? সোহা বুঝতে পারছে ও তন্ময়ের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছে। তন্ময়ের ঔষদ, গোসল, ঘুম, খাওয়া সবকিছুর দেখাশুনা সোহা একাই করছে। রাত জেগে তন্ময়ের সেবা করেছে, ঘুমের ঘোরে তন্ময় তাকে কতদিন জড়িয়ে ধরেছে। এ যেন এক অন্যরকম অনুভুতি। সোহা বাধা দেয়নি। কিন্তু আর নয়, এখন থেকে ওকে দূরে দূরে থাকতে হবে।
তন্ময়কে ভুলে থাকার জন্য আমাকে শান কে নিয়ে ব্যস্থ থাকতে হবে। আর একটা মাস কোনমতে কাটিয়ে দিলে আমার চুক্তি শেষ। শানকে নিয়ে বসে বসে এসব ভাবছে সোহা।
শান এখন হামগুড়ি দেয়, খিলখিল হাসে, ওকে মাম্মাম ডাকে। সারা বাড়ির চোখের মনি এখন শান। মিনহাজ সাহেব ও শান কে ছাড়া এক মুহুর্তও থাকতে পারেন না।
এদিকে নীরা ও ধরা পড়েছে ঐ ডাক্তারের স্বীকারুক্তি তে। ওরা তন্ময় কে পাগল করার চেষ্টা করেছে। নীরা বলেছে- তন্ময় অনেক ব্রাইট স্টুডেন্ট ছিল, ইন্টারনিশীপ এর সময় ও এমন একটা ঔষদ আবিস্কার করেছে যেটা সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এটা এমন এক ধরনের ঔষদ যেটা দিয়ে মানুষকে যেমন বাঁচানো যায়, তেমনি মারাও যায়। কিন্তু কোন ডাক্তার তা ধরতে পারবে না।তাই ওকে প্রেমের অভিনয় করে ফাঁসায় ওই ফরমুলা আর ঔষদ হাত করার জন্য। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে তন্ময়ের বাবা মা বিয়ের প্রস্তাব দিবেন ভাবে নি। কিন্তু ফরমুলার জন্য তন্ময়কে বাধ্য হয়ে বিয়ে করে। তন্ময়কে অনেক বলার পর ও তন্ময় নীরাকে ঐ ফরমুলা দেখায়নি, এজন্য ও বউ সেজে ঐ বাড়িতে থেকে ফরমুলা টা খুজে বের করার চেষ্টা করে, সাথে তন্ময়কে পাগল করার জন্য ওর দুধের সাথে প্রতিদিন ঔষদ খাওয়ানো শুরু করে।
এর মধ্যে এতটা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে বুঝতে পারে নি ও কখন প্রেগন্যান্ট হয়। নীরা বাচ্চা এবরশন করাতে চাইলে তন্ময় বাধা দেয়, তখন থেকে ওদের মধ্যে ঝগড়া হয়। নীরা বলে যদি আমাকে ঐ ফরমুলাটা দেও তাহলে আমি বেবি নেবো নাহলে না। কিন্তু তন্ময় ওর মনের ভাব বুঝতে পেরে যায়। তাই ও বলে বাচ্চা হয়ে গেলে ফরমুলা তোমাকে দেবো। কিন্তু তন্ময় ফরমুলা নীরা কে দেয়নি। যেদিন বেবি হয় তার আগের দিন নীরা ফরমুলা চুরি করে। বেবি হওয়ার পর ওকে হসপিটালে রেখে ফরমুলা নিয়ে চলে যায়। এটা বুঝতে পেরে যায় তন্ময়। তন্ময় ওর কাছে ঔষদ আর ফরমুলা দিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে। বুঝায় ওকে এতে অনেক মানুষের জীবন মরনের প্রশ্ন। ততদিনে নীরা তাদের সব সাঙ্গপাঙ্গ দের নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে। সেটাও তন্ময় জেনে যায় আর তাই ওরা পাগলের ডাবল ডৌজ দিয়ে ওকে মানসিক ভাবে পুরা অসুস্থ করে দেয়। ঐ ডাক্তার ও তাদের সাথের একজন, ডাক্তার তন্ময় কে ড্রাগ দিয়ে এমন সব ভয়ংকর জিনিস ওর চোখের সামনে আনতো, তন্ময় পুরোপুরিভাবে পাগল আর ভয় পাওয়া শুরু করে। বাচ্চা টাকেও ওরা ভয়ের উপকরন বানিয়ে দেয়। তাই তন্ময় এখন ও বাচ্চাকে সহ্য করতে পারে না।
পুলিশ এসব কথা শুনে হসপিটালের নাম অনুযায়ী তদন্ত করে জানতে পারে এই ফরমুলা আর ঔষদ দিয়ে ওরা আরও ভয়ংকর ঔষদ বানিয়েছে। আর ওরা একটা গ্যাং, কিডনি চুরি করে বিদেশে পাচার করে ওদের মাধ্যমে অনেক মানুষ মারা গেছে।
নীরা আর ডাক্তারের দেওয়া তথ্যানুযায়ী সবাইকে ধরা হয় আদালত ওদের যাবতজীবন কারাদণ্ড শাস্তি দেয়।
একদিন সকালে সোহা শানকে নিয়ে লনে হাটছে। এমন সময় তন্ময় আসলো ওর পাশে। সোহা তন্ময়কে ভয় পেয়ে শানকে জড়িয়ে ধরলো। ওর কাছ থেকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলো।
- সোহা দাঁড়াও, যেওনা। তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
- জ্বি, কি কথা বলুন।
- আগে তো তুমি করে কথা বলতে এখন আপনিতে চলে আসছো?
- দেখুন আগে আপনি অসুস্থ ছিলেন তাই, এখন ভালো হয়ে গেছেন।
- তার মানে আগে বউ ছিলে এখন বউ নও?
- ইয়ে মানে। আমি আপনার বউ....
- বউ নয়, আমি জানি, মা আমাকে সব বলেছেন। আজকের যুগে কোন মেয়ে নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে এতকিছু করবে না। আমি তোমার কাছে চির কৃতজ্ঞ।
সোহা বললো আমি আমার কাজ করেছি। এখানে কৃতজ্ঞতার কিছু নেই।
শান কে আমার কাছে দাও বলে তন্ময় সোহার দিকে হাত বাড়ালো।
- ইয়ে মানে,.. না দেবো না। আপনি ওকে মারতে চান।
- কি বলছো সোহা! ও আমার ছেলে। আমি এখন সুস্থ, ওকে কেন মারবো?
সোহা তারপর ও দাঁড়িয়ে আছে।
"দাও মা শান কে ওর কাছে দাও" বলে তন্ময়ের মা সামনে আসলেন। সোহা ভয়ে ভয়ে শানকে তন্ময়ের কোলে দিল। তন্ময় আলতো করে শানের কপালে চুমু একেঁ দিয়ে শান কে জড়িয়ে ধরলো।
ওর মুখে হাসি আর চোখে পানি, এতদিন পর এ যেন এক অপূর্ব মিলন। জন্মের পর থেকে তন্ময় একবারের জন্য শান কে কোলে নেয়নি।
এ দৃশ্য দেখে সোহার চোখেও পানি এসে গেল।
দেখতে দেখতে একটা মাস শেষ হয়ে গেল। এ বাড়ির সবকিছু যেন সোহার আপন হয়ে উঠলো। যতই দেশে ফিরে আসার কথা মনে পড়ছে ততই ওর কান্না পাচ্ছে। ও কিভাবে শান কে ছাড়া থাকবে। তন্ময়কে ভুলে থাকবে। যতই চুক্তিপত্র থাকুক সোহা যেন এ বাড়ির বউ হয়েছিল এতদিন সবার ভালবাসা, সুন্দর আচরন ও ভুলতে পারবে না। শান কে ও জন্ম না দিলেও মনে হয় শান যেন তার আত্মার আত্মীয়। তন্ময় ও ভাল হয়ে গেছে, সব সমস্যার ও সমাধান হয়ে গেছে। সোহা তার রুমে শুয়ে এসব ভাবছিল।
আসতে পারি ম্যাডাম?
তাকিয়ে দেখে দরজায় তন্ময় দাঁড়িয়ে আছে।
জ্বি আসুন বলে সোহা উঠে দাঁড়ালো। তন্ময় এসে একটি চেয়ারে বসে সোহাকে ও বসতে বললো।
সোহা বসার পর তন্ময় বললো, শুনলাম তুমি নাকি দেশে চলে যাবে?
- জ্বি চলে যাচ্ছি, আমার সময় শেষ। বলে সোহা মাথা নিচু করলো।
- আর কিছুদিন থাকা যায়না?
সোহা ওর দিকে মুখ তুলে তাকালো আর মনে মনে ভাবলো, আমি তো সারাজীবন থাকতে চাই তন্ময়, কিন্তু তা যে সম্ভব নয়।
- না মানে সোহা তুমি কিছু মনে করোনা। আমাদের পিছনে এই ছয়টা মাস সময় দিয়েছো তুমি। একটু সময় ফুরসত পাওনি আরও কিছুদিন থেকে যাও। আমরা ঘুরবো, পিকনিক করবো। আচ্ছা ঠিক আছে, আমি থাকবো। এই বাহানায় নাহয় আরও কিছুদিন শান কে কাছে পাবো।
তন্ময় ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো আচ্ছা ঠিক আছে আমি যাচ্ছি তুমি থাকো।
আরও একটা মাস যেন স্বপ্নের মত চলে গেল। সোহা, তন্ময়, শান, আর বাবা মা সবাই মিলে অনেক ঘুরাঘুরি করলো। ইংলেন্ড এর সব আকর্ষনীয় জায়গা পিকনিক স্পট ঘুরলো ওরা। এর মধ্যে তন্ময় ফরমুলার মাধ্যমে ঔষদের প্রতিষেধক ও আবিস্কার করে ফেলেছে। হাসপাতালেও কাজে যোগ দিয়েছে। ও এই বছরের সেরা ডাক্তারের এবং গবেষকের এওয়ার্ড পাবে।
সোহা বাড়িতে ফোন দিয়ে বললো যে ও দুইদিন পর বাড়িতে আসছে। ওর বাবা জিজ্ঞেস করলেন জামাই বাবা কি আসবে না মা?
- না বাবা উনি খুব ব্যস্ত, আমি একা আসবো, আসার পর তোমাদের সাথে কথা বলবো। অনেক কথা জমা আছে বাবা।
-কেন মা, কি হয়েছে? কোন সমস্যা হয়েছে কি?
- কিছু হয়নি বাবা, তুমি চিন্তা করনা তো। আমি এখন রাখি।
সোহা লাইন কেটে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
তন্ময়ের মা দরজায় দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন। তিনি এসে সোহাকে ধরে বললেন তুমি থেকে যাও মা। আমি তন্ময় আর ওর বাবার সাথে কথা বলবো তোমাদের বিয়ের বিষয়ে।
- না মা, তা হয় না। আপনি উনাদের কিছু বলবেন না। বলে উনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
ওর মনে অভিমানে ভরা। তন্ময় কি কিছু বুঝেনা? ও কেন আমাকে আটকায় না। আমি যে ওকে ভালবাসি ও কি বুঝেনা? ও আমাকে হয়তো ভালবাসে না তাই এতে ওর কিছু আসে যায়না।
- মা আমি এই দুইদিন শান কে নিয়ে নিরিবিলি থাকতে চাই।
- ওকে মা, তুমি যা চাও তাই হবে।
তন্ময় নিজে দৌড়া দৌড়ি করে ভিসার আর টিকেট এর ব্যবস্থা করলো।
আসার দিন সবাই সোহাকে এগিয়ে দিতে আসলো। সারক্ষণ সোহা শান কে কোলে কোলে রাখছে। শান কে ছাড়া থাকতে হবে ভেবে বার বার তারর চোখ ভিজে যাচ্ছিল। মন থেকে চাচ্ছিল একবার তন্ময় তাকে থেকে যাওয়ার কথা বলুক। তন্ময় ও মন খারাপ করে আছে। তন্ময় ও সোহাকে এই কয়দিনে ভালবেসে ফেলেছে। কিন্তু এমনিতে সোহা তার জন্য এতকিছু করছে, এখন কোন মুখে সে বিয়ের কথা বলবে। এসব ভাবছিল।
অবশেষে সোহা একরাশ অভিমান, দুঃখ নিয়ে দেশের মাটিতে পা রাখলো। সবাই তাকে নিয়ে আসতে এয়ারপোর্ট এ আসছে। সোহা সবাইকে জড়িয়ে ধরলো। আজ থেকে ৭ মাস আগে সোহা এখান থেকে বউ সেজে অজানার উদ্দেশ্যে লন্ডনে গিয়েছিল। আর আজ.? আজ জীবনের মোড় টাই বদলে গেছে।
৫ম ও শেষ কিস্তি...
সোহাকে নিয়ে সবাই বাড়িতে আসছে, সবাই খুশী, এটা সেটা ওকে গাড়িতে বসে জিজ্ঞাসা করলো। কিন্তু সোহা একটা কথার ও উত্তর দিলো না।গাড়ি গেট দিয়ে ঢোকার সময় সোহা জিজ্ঞেস করলো এ কার বাড়ি বাবা? এখানে কেন নিয়ে এসেছো?
- কেন এটা আমাদের বাড়ি? তুই জানিস না?
- কি জানবো বাবা? সোহা অবাক হয়ে গেলো।
- আচ্ছা ঠিক আছে আগে তুই বিশ্রাম কর। পরে বলবো অনেক জার্নি করেছিস।
সোহা ও আর কিছু বললো না। ওর কাছে কোন কিছুই আর ভাল লাগেনা। ও যেন সব কিছুর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে ও নিরবে নিজের রুম এ চলে গেলো। ওর এই নিরবতা দেখে সোহার মা বললেন, নিশ্চয়ই মেয়েটার কিছু হয়েছে। নাহলে তো মেয়েটা এত নিরব কোনদিন থাকে না।
সোহার বাবা বললেন, তুমি ঠিক কথা বলেছো। আমি বড় মেয়েকে আসার কথা বলছি। ও এসে জিজ্ঞেস করবে। হয়তো ওকে সব বলতে পারে।
সন্ধার সময় সোহার বাবা মা ভাই বোন সবাই সোহার রুমে আসলো।
ওর ভাই বললো, আপু এতদিন পর দেশে আসলে আমাদের জন্য কিছু আনলে না?
- না রে ভাই, এতটা ব্যস্ত ছিলাম কিছু কিনতে পারিনি।
- তুমি চাবি দেও আমরা দেখছি।
- কিচ্ছু আনিনি তো।
- তুমি দাওতো বলে সোহার বোন ওর পার্স থেকে চাবি নিয়ে চলে গেল। সোহা আর কিছু বললো না। "গিয়ে দেখুক গে আমি যে কিছু আনিনি।" মনে মনে ভাবলো।
সোহার মা বলতে লাগলেন, - কি হয়েছে সোহা তোর? তুই কেন এতটা উদাস হয়ে আছিস?
- কিছু না মা, এতদিন পর আসছি তো, শান এর কথা খুব মনে পড়ছে।
- শান? শান আবার কে?
হঠাৎ মুখ ফসকে বলে দিছে, এখন বুঝতে পারলো।
- মা শান উনাদের এক আত্মীয়ের ছেলে খুব ছোট। ওকে আমি আদর করতাম, নিজের সাথে রাখতাম। এখন এসব বাদ দেও, আগে বলো এ বাড়ি কোথা থেকে আসলো? কে বানিয়ে দিছে? এত টাকা তোমরা কোথায় পেলে?
সোহার বাবা বলতে শুরু করলেন, তুই যাওয়ার এক মাস পরে তোর শশুর আমাদের বাড়ি তে আসেন। তিনি বলেন আপনাদের সোহা ওইখানে অনেক বড় চাকরি করে। ও যখন দেশে আসবে, এসে যদি দেখে আপনারা এই বাড়ি তে এখন ও আছেন তাহলে কি মনে করবে? আমরা কিছু বলতে পারলাম না, কারন আমাদের তো কোন সামর্থ্য নাই।
উনি বললেন আপনারা কোন চিন্তা করবেন না ও যে বেতন পাবে ও আমার কাছে দেবে, আমি সব ব্যবস্থা করবো। আর সোহাকেও কিছু বলবেন না, ও এসে দেখে যেন চমকে যায়। আমরা বললাম সোহাকে খুশী করার জন্য তাই করবো।
এরপর উনি এই কয় মাসের ভিতরে জায়গা কিনে এই বাড়ি বানালেন, গাড়ি কিনে দিলেন, আর আমাদের চলার জন্য একটা ব্যবসার ব্যবস্থা করলেন। সত্যিই মা তুই এত টাকা বেতন পাস? কি কাজ করিস ওখানে?
- সোহা এসব শুনে একদিকে খুব খুশী হয়েছে, এত ভাল মানুষ উনারা। কিন্তু অন্যদিকে মনে হচ্ছে এসব কিছু দয়ার দক্ষিণা। ও এই দয়া চায় না।
সে তার বাবাকে বললো, একবার তো জিজ্ঞেস করতে পারতে বাবা? আমি যে টাকা পাই সেই টাকা দিয়ে এ বাড়ির দশহাত জমিও কিনা যাবে না। এত কিছু কিভাবে করবো? আর আমি কি কখনো তোমাকে এসব বলেছি? আমার বাড়ি গাড়ি চাই? আমি তোমাদের নিয়ে শান্তিতে দু মুঠো ভাত খেতে চাই।
- ঠিক রে মা, হয়তো তোর শশুর বলে এরকম করেছেন। আসলে মা এরকম মানুষ পৃথিবী তে বিরল। এই স্বার্থেরর পৃথিবী তে এই নিঃস্বার্থ মানুষটাকে দেখলেই শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছা করে।
সোহার মা বললেন, আচ্ছা এখন বল ও বাড়ির সবাই ভালো তো? জামাই, তোর শাশুড়ি?
সোহা এ কথা শুনে গম্ভির হয়ে গেল।
- কি হলো কথা বলছিস না কেন?
- হ্যা মা সবাই অনেক ভালো। তন্ময় সাহেব তো সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকেন তারপর ও যতটুকু সময় পান আমরা বাইরে যাই, পিকনিক করি। কথাটা ঘুরিয়ে বললো সোহা।
- তাহলে আসলো না কেন?
- মা ডাক্তার মানুষেরা তো নিজের খুশীর চাইতে মানুষের সেবা তেই বেশী খুশী থাকে। তাই আমিই বলছি আসা লাগবে না।
এমন সময় ওর ভাইবোন গুলো হৈ হুল্লোড় করে রুমে ঢুকলো।
- আপু তুমি না করলে কিচ্ছু আন নি? তাহলে এত কিছু কে আনলো আমাদের জন্য? সোহা দেখলো বোনের জন্য কাপড়, কসমেটিকস্ সামগ্রী, কলম, ক্যালকুলেটর আরও ওর পছন্দের অনেক জিনিস। ভাই এর জন্য ঘড়ি, মোবাইল ফোন, আরও যা যা লাগে অনেক দামি দামি জিনিস। বাবা মা এর জন্যও অনেক কিছু। সবকিছুতে প্যাকেট করে যার যার নাম লেখা। এসব তো সোহা কিনেনি, তাহলে কে কিনল? ও একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে দেখলো হাতের লিখা তন্ময়ের। ও এসব কখন করলো? হয়তো শেষ দুইদিন ও এসব কিনে প্যাকেট করেছে তখন তো সোহা একবারও তন্ময়ের সামনে যায়নি। আসার সময় ও ওর মাথায় চিন্তা ছিল বলে খেয়াল করেনি।
ও এত কিছু করলো কেন? এতকিছু না করে একবার কি বলতে পারতো না সোহা আমি তোমাকে ভালবাসি, বিয়ে করতে চাই। মনের অজান্তে চোখে পানি চলে আসলো।
সোহার ভাই সোহার চোখে পানিদেখে বললো, আপু তুমি কাঁদছো কেন? আমরা এসব খুলেছি বলে কি কষ্ট পেয়েছো?
তাড়াতাড়ি চোখ মুছে সোহা বললো, দূর পাগল আমি খুশী হয়েছি। এসব আমি কিনি নি, সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য আমার অজান্তেই তন্ময় কিনেছে। তোরা খুশী তো..?
- খুশী মানে? দুলাভাই ইজ গ্রেট" বলে ও উল্লাস প্রকাশ করলো।
- আচ্ছা যাও সবাই এখন আমি একটু একা থাকতে চাই।
পরদিন সকালে সোহার বোন আসলো, জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে সোহা? তুই নাকি একেবারে আনমনা হয়ে গেছিস?
- কিছু না আপু এমনি।
- বল আমাকে, মনের কষ্ট হালকা হবে।
সোহা তার আপু কে সব কিছু বলে ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
সোহার আপু এসব শুনে নিরবে রুম থেকে চলে গেলেন।
উনি সবাইকে এসব বললেন। ওর মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন আমার মেয়ে চুক্তি বিয়ে করেছে। আমাদের জন্য এত নিচে নেমেছে।
সবাই সোহার রুমে আসলো। সোহার বাবা জিজ্ঞেস করলেন, এসব কি শুনছি সোহা? টাকার জন্য আমার মেয়ে হয়ে তুই এত নিচে নামতে পারলি? নিজের জীবনের এত বড় ক্ষতি করলি? কেন? আমি কি মরে গেছিলাম?
- বাবা আমি জানি, আমি ভুল করেছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভালো করেছি। একটা পরিবার আর দুইটা জীবন রক্ষা করতে পারছি আল্লাহর সাহায্যে। এটাই আমার কাছে বড় পাওয়া।
- না, এ হতে পারে না। আমার বোন এতকিছু করবে আর ওরা স্বার্থপর এর মত নিতে থাকবে এ হয়না। আমি উনাদের সাথে, তন্ময়ের সাথে কথা বলবো।
- না আপু, ওরা স্বার্থপর নয়। আমাদের জন্য ও তো ওরা এত কিছু করেছে। তারপর অভিমান ভরা গলায় বললো। তুমি কেন বলবে, ওর কি কিছু আসে যায়না। ও কি বুঝে না?
সবাই এ কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো। বুঝতে পারলো সোহার মনেও অভিমান কাজ করছে। আর কিছু না বলে নিরবে চলে গেলেন রুম থেকে।
এক সপ্তাহ হয়ে গেলো, মিনহাজ সাহেব আর তন্ময়ের মা নিয়মিত সোহাকে ফোন করেন। কিন্তু তন্ময় একবারের জন্যও সোহাকে ফোন, মেসেজ করেনি। যতদিন যাচ্ছে সোহা আরও মনমরা হয়ে যাচ্ছে, রুম থেকেও বেশী বের হয়না। ঠিক মত খাওয়া দাওয়া ও করছে না। ওর অবস্থা দেখে সোহার মা নিরবে শুধু কাঁদছেন।
একদিন সকালবেলা কি এক দরকারে পার্স খুললো। দেখলো একটা গোলাপি এনভেলাপ সাথে দুইটা গোলাপ ফুল বাধা। গোলাপ গুলো শুকিয়ে গেছে। ও কাঁপা কাঁপা হাতে এনভেলাপ টি খুললো। হাতে তন্ময়ের লেখা চিঠি। তন্ময় লিখেছে-
"সোহা"
তুমি আজ চলে যাচ্ছো, কিন্তু তোমাকে আটকানোর ক্ষমতা বা অধিকার আমার নেই। যে কয়দিন আমি ভালো ছিলাম, তোমার সাথে কাটানো প্রতিটা দিন আমার কাছে স্বপ্নের মতো লেগেছে। প্রতি টা দিন আমার কাছে মনে হয়েছে, নতুন করে স্বপ্ন দেখার দিন, বেঁচে থাকার দিন। আমি জানিনা আমার মনের ভুল কিনা, আমিও তোমার চোখে আমার জন্য এক সাগর মায়া দেখেছি, ভালবাসা দেখেছি। তারপর ও কিছু বলতে পারিনি তোমায়। আমার বিবেক বাধা দিয়েছে যদি আমার দেখাটা ভুল হয়? এমনি তে তুমি আমার জন্য এতকিছু করেছো। আমি তোমার জন্য নতুন করে জীবন ফিরে পেয়েছি, বাঁচতে শিখেছি। হয়তো ভালো হতাম, কিন্তু সারাজীবন ভালবাসার প্রতি ঘৃণা নিয়ে বেঁচে থাকতাম। তুমি ই আমাকে শিখিয়েছো, পাওয়া নয় ত্যাগের নামই প্রকৃত ভালবাসা। আর আমার মনের কথা গুলা যদি সঠিক হয়, আমাকে যদি তুমি সত্যিই ভালবেসে থাকো তাহলে আমার নাম্বারে একটা ফোন দিও। আমি বুঝে যাবো তুমিও আমাকে ভালবাসো, তখনি আমি চলে আসবো তোমাকে আপন করে নিতে, আমার শান এর মা বানিয়ে নিতে। আমি সারাটি জীবন তোমার ফোনের অপেক্ষায় থাকবো।
- তোমারই "তন্ময়"
সোহা চিঠি পড়ে থ হয়ে বসে থাকলো। তাহলে তার অনুমান ঠিক, তার ভালবাসা ব্যর্থ হয়নি। সেজন্যই তন্ময় তাকে ফোন করেনি। এতদিন থেকে কেন পার্স খুললো না চিঠি দেখলো না আফসোস করলো।
ও তাড়াতাড়ি তন্ময়ের নাম্বারে ফোন করলো।
তন্ময় ফোন ধরে বললো, সোহা আমি প্রতিটা দিন প্রতিটা ঘন্টা তোমার ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম।
- বুদ্ধু কোথাকার, একবার তো বলেই দেখতেন।
- আমি পারিনি সোহা, মনে ভয় ছিল যদি তোমাকে হারিয়ে ফেলি। যদি আর তোমার সামনে দাঁড়াতে না পারি?
- এখন কি এসে দাঁড়াতে পারবেন মি. তন্ময়?
- ইয়াহ্ এখন পারবো মিসেস তন্ময়।
- কি..?!
- ওহ্ থুক্ষু! এখনও মিসেস হওনি। কিন্তু শান এর মা তো হয়ে গেছো তাইনা?
- হুমম।
- তাহলে আমরা আগামী দুইদিনের ভিতরেই দেশে আসছি। আসল পাগলামীর জন্য রেডি থাকো।
- "পাগল একটা বলে" সোহা হাসতে হাসতে বিছানায় গড়িয়ে পড়লো।