"পিচ্চি বউয়ের কারসাজি - ২"
"মেহজাবিন মুন"
-- আব্বু আব্বু মাম্মি আমাতে আইততিরিম দেয় না। খালি মালে।
-- তাই আব্বু? আচ্ছা আমি তোমাকে এত্তগুলা আইসক্রিম দেবো হবে?
-- আগে আম্মু কে মালো।
-- আচ্ছা চলো দুজনে মিলে মারবো।
ফারহান মেয়েকে কুলে নিয়ে আসতে আসতে মৌমিকে ডাক দিল।
-- মৌমি মৌমি কই তুমি?
তোমার উপরে কেস আছে।
এতক্ষণ থেকে আসছো না যে সামনে?
-- আসবো কি করে? বাবা মেয়ের কান্ড দেখছি। সারা দিন আইসক্রিম করে করে বাড়ি মাথায় তুলবে। ঠান্ডা লাগলে তখন তো আমার বারটা।
-- বকছো কেন? মেয়েটা তো তোমার মত হয়েছে। তুমি কম আইসক্রিম খাইতে নাকি?
-- দেখো মধ্যখানে আমাকে ঢুকাবে না। তুমিই ওকে আস্কারা দিচ্ছ।
-- বুঝতে হবে না মেয়েটা কার?
-- মেয়ে কি শুধু আমার? আমি ওকে আইসক্রিম খাওয়া শিখাইছি?
"আব্বু তুমি মাম্মিকে মালো" মাঝখানে এই কথা বলে ওদের ঝগড়া শেষ করে দিল। মেয়ের কথায় দুজনেই হেসে দিল।
ফারহান আর মৌমির ছোট্ট সংসারে এখন আরও একজন এসে যোগ দিয়েছে।
মায়া, দু বছরের মেয়ে। আদো আদো কথা বলে মায়া। সারাটা বাড়ি মাথায় তুলে ছাড়ে। সারাক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি।
ফারহানই ওর নাম রেখেছে মায়া। ওদের অকৃত্রিম মায়া আর ভালবাসার ফল যে এই মায়া।
মৌমি আজ পুরোপুরি বড় হয়ে গেছে সংসার সামলাচ্ছে। কে বলবে এই মেয়েটি একসময় পিচ্চি বউ ছিল?
সেদিন বাসায় আসার পর মৌমি ফারহানকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদলো। ফারহান ও মৌমির কান্না দেখে কেঁদে ফেললো।
-- তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও মৌমি। আমি তোমাকে সঠিক ভাবে দেখাশুনা করিনি। আমি তোমাকে একবার দেখতে যেতে পারিনি। যদি তুমি আমাকে দেখে পাছে আবার পাগল হয়ে যাও।
-- না ফারহান তোমার দোষ নেই। আজকের যোগে কোথায় এমন স্বামী পাওয়া যায়, যে তার সবকিছু বিসর্জন দিয়ে বউয়ের চিন্তা করে। তাও এমন বউ,যে স্বামী শব্দের মানেই কি বুঝে না।
-- এইসব বলিও না। আমি তোমাকে আমার অন্তর থেকে মেনে নিছি। ভালবেসেছি। এখন বলো কিভাবে কি হলো?
-- আরে আগে তো কিছু খাই চলো। খুব ক্ষিদা লাগছে। না খেয়েই ওখান থেকে এসেছি। তারপর ফারহানের হাত ধরে রান্নাঘরে যেতে লাগলো।
-- আচ্ছা মৌমি, তুমি আমার অফিসের ঠিকানা পেলে কিভাবে?
-- কেন? শশুড় সাহেবের কাছ থেকে নিয়েছি।
-- তারমানে সবাই জানতো তুমি ভালো হয়েছো? আমি শুধু...!!
-- হুমম। ইটস্ সারপ্রাইজ!! অবশ্য সবাই না
আমার শশুর বাড়ির সবাই আর আমার আম্মু জানেন। বাকিটা সবার জন্য সারপ্রাইজ।
মৌমি ঝটপট নাস্তা বানিয়ে বললো চলো খাওয়া শেষ করি। আর বাজার তো কিছু নাই খাও কি?
-- কখনও বাইরে খাই, কখন ও খাইনা।
-- এভাবে করলে হবে? যাক আমি এসে গেছি। এখন আর না খেয়ে থাকতে হবে না। আর লিস্ট লিখে দিচ্ছি, সব কিছু নিয়ে আসবে।
-- আমি তো অবাকের পর অবাক হচ্ছি। তুৃমি এত কিছু শিখলে কিভাবে? প্লিজ বলো না মৌমি? তোমার সারপ্রাইজ এর জন্য পরে হার্টঅ্যাটাক করবো।
-- হার্ট অ্যাটাক হলে হবে নাকি মি. এখন তো সবকিছুই বাকি আমাদের। বলে মৌমি পাশের চেয়ারে বসলো।
-- এতদিন তুমি আমাকে খাইয়েছো, আজ থেকে আমি তোমাকে খাওয়াবো।
-- শোধ করে দিতে চাইছো?
-- ভালবাসা কি শোধ করা যায়? এ যে অনন্তকাল ধরে চলতে থাকা কোন ফরমান। স্বামী স্ত্রীর এ ভালবাসা আল্লাহ যে নিজে সৃষ্টি করেছেন। এ শেষ হওয়ার নয় ফারহান। তুমি আমি চাইলেও শেষ করতে পারবো না।
আচ্ছা এখন বলো কিভাবে কি হলো?
তুমি যখন আমাকে আর আম্মুকে ওই বাড়িতে রেখে আসলে। নার্স রাও নিবিড় পরিচর্যা করলো। কয়েকদিনের ভিতরে ড্রাগ এর ভাব কেটে গেলো। কিন্তু তখন ও ভয় পাইতাম। তোমার কথা মনে হলে অজানা একটা কষ্টে কাঁদতাম। ঔষদ, পরিচর্যা আর আম্মুর কেয়ারের কারনে ভালো হতে লাগলাম। কিন্তু তোমার প্রতি ভয় আর ঘৃণা বাড়তে থাকলো। কেউ তোমার নাম উচ্চারন করলে তাকে বকা শুরু করে দিতাম। মনে হত তুমি রাখিকে বিয়ে করেছো। রাখিই আমাকে বউ সেজে দেখাতো। ওর ভাইকে তুমি সাজিয়ে ওর পাশে বসাতো। তাই এটা ভাবাই স্বাভাবিক।
আমার অবস্থা দেখে আম্মু তোমার আম্মুকে ফোন করে সব বললেন।
সব কিছু শুনে আম্মু ফারিয়া, বাবাকে নিয়ে ওই বাড়িতে আসলেন। তখন তিন মাস হয়ে গেছে।
ফারিয়া কে, আম্মুকে দেখে আমি আরও বেশি কাঁদতাম।
তখন আম্মু আমাকে বুঝালেন, যে রাখিকে পুলিশ নিয়ে গেছে। আর আসতে পারবে না আমাদের বাড়ি। এসব অনেককিছু।
ফারিয়া সবসময় তোমার পজিটিভ দিক গুলা, আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা সব কিছু আমাকে বলতো। একসময় ওর কথা শুনতে শুনতে তোমার প্রতি আমার কেন যেন একটা টান সৃষ্টি হলো। কিন্তু হঠাৎ করে সব ভুলে যেতাম। আবারও পাগলামী শুরু করতাম। শশুর শাশুড়ি আম্মু ফারিয়া সবার অক্লান্ত পরিশ্রম আর আল্লাহ র অশেষ দয়ায় আমি ভালো হলাম। তোমার কাছে আসতে চাইলাম। কিন্তু ফারিয়া বললো, না ভাবি, এভাবে নয়। ভাবি তোমাকে যেভাবে দেখতে চায় সেভাই যাবে। ভাইয়াকে সারপ্রাইজ আর খুশি করা যাবে। আমিও ওর কথায় রাজি হলাম। শুরু হলো ওদের কাজ আর আমার চেষ্টা। ওরা ঘুমানো পর রাত জেগে পরাশুনা করতাম। রান্না শিখতাম, কাপড় পরা শিখতাম। কত রাত যে নির্ঘুম কাটিয়েছি বলতে পারবো না। শুধু ছটফট করতাম তোমার কাছে আসার জন্য। একসময় আমার সবকিছুর ট্রেনিং শেষ হলে। সবাই বললে আমি পারফেক্ট। আর এত তাড়াতাড়ি আমি এতকিছু শিখছি। ওরা তো অবাক। কিন্তু আমি তো জানি, তোমার ভালবাসাই আমাকে এতদূর নিয়ে আসতে বাধ্য করেছে। তারপর কথায় কথায় টিকানা যেনে আজ চিঠিতে তোমার কাছে আসছি লিখে চলে আসলাম। আর এখন আমি তোমার পাশে বসে আছি। বলে মৌমি ওকে জড়িয়ে ধরলো।
-- কিন্তু আমি চাই আমার পিচ্চি বউটা আমাকে জ্বালাক, আইসক্রিম এর বায়না ধরুক, দুষ্টামি করুক, রাত হলে ভয় পেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরুক বলে ফারহান চোখের পানি মুছলো।
-- এই যে জনাব, ভালো হয়ে গেছি মানে কি আইসক্রিম খাওয়া বাদ দিয়েছি? আর ভয়ে নয়, ভালবাসার পরশে জড়াবো তোমায়।
একটু পরে দরজায় নক করার আওয়াজ শুনা গেলো।
ফারহান বললো, মনে হয় আব্বা আম্মা এসে গেছেন। দেখি দরজা খুলি।
তুমি বসো আমি খুলছি।
সবাই আসলো, সবাই অনেক খুশী। ফারহান ফারিয়া কে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো,
--থ্যাংকিউ বোন তুই যে পিচ্চি টাকে আমার মনের মত করে দিয়েছিস।
-- আমার ভাইয়ের ভালবাসা তো মিথ্যা হতে দিতে পারিনা। কিন্তু আমি একা নয়, সবাই পরিশ্রম করছি। আর বিশেষ করে ভাবির চেষ্টাতে সব হয়েছে।
-- হুমম, এবার আমি মৌমিকে ওদের বাড়িতে নিয়ে দেখিয়ে আসবো, আমার বউ পাগলী নয়।
এমন সময় সবার জন্য নাস্তা নিয়ে এলো মৌমি।
-- তুমি নাস্তা বানালে কখন? শাশুড়ি মা জিজ্ঞাস করলেন।
-- আমি জানতাম আম্মু আপনারা এখানে আসবেন, তাই আগে ই বানিয়ে রেখেছি।
পিচ্চি টা তো দেখি অনেক বড় আর চালাক হয়ে গেছে।
ফারহানের কথায় সবাই হেসে উঠলো।
সবাই সেদিন অনেক আনন্দ করলো। দুইদিন পর যখন মৌমিদের বাড়িতে ওরা সবাই গেলো বাড়ির সবাই তো অনেক অবাক।
পাগলী মেয়েটা যে এখন সত্যি ভালো হয়ে গেছে। যারা ওকে পাগলী বলতো তারা তো হিংসায় শেষ। কিন্তু কিছু তো করতেও পারছে না। ফারহান মনে মনে বললো, দেখো আমার পাগলী বউ আজ ভালো বউ হয়ে গেছে। যা আমি এই বাড়িতে বসেই ওয়াদা করেছিলাম।
মৌমিদের বাড়ি ঘুরে ফারহানদের বাড়িতেও দুদিন মৌমি আর ফারহান থাকলো।
অনেক ঘুরাঘুরি করলো।
তারপর আবার সেই ভালবাসার নীড় শহুরে বাসা।
মাঝে মাঝে এখন ও মৌমি অন্যমনস্ক হয়ে যায়। কখনও ফারহান কে দেখে চমকে উঠে, চিৎকার করে উঠে। ফারহান ওকে ভালবাসা দিয়ে আগলে রাখে।
মৌমি তার নিজের মতো করে সমস্ত বাসা সাজিয়েছে। কিন্তু সবকিছুতেই বাচ্চা বাচ্চা ভাব।
ফারহান বলে, তুমি কি বড় হওনি এখনও?
-- হয়েচি তো। এখন আইসক্রিম দাও।
-- আবার "চ".!
-- মাঝে মাঝে বলতে দাওনা। নাহয় কেঁদে দেবো
-- পিচ্চি তো দেখি সত্যিই পিচ্চি হয়ে গেছে।
-- হুম মাঝে মাঝে হয়ে যাবো।
দুজনে মিলেই সারাদিন গল্প করলো আইসক্রিম খেলো।
কিন্তু পরদিন বিকালে ফারহান এসে দেখলো মৌমি বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে কাঁপছে। ফারহান কে দেখে মৌমি চিৎকার শুরু করে দিলো।
-- তুমি চলে যাও, চলে যাও। আমি তোমাকে দেখতে চাইনা
-- মৌমি তোমার কি হয়েছে? এমন করছো কেন?
-- কাছে আসবে না, নাহলে খামচি দেবো।
-- মৌমি..?
মৌমি ভয়ে বেহুশ হয়ে গেলো।
ফারহান মৌমি কে নিয়ে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে আসলো।
ডাক্তার চেকআপ করলেন, ওর সাথে কথা বললেন।
তাটপর ফারহান কে জিজ্ঞেস করলেন,
আপনার বাসায় কি আর কেউ থাকে?
-- জ্বি না।
-- কোন কাজের লোক?
-- আগে ছিল, মৌমি মানা করে দিছে, ওর ঘর ও সামলাবে কোন কাজের মেয়ে নয়।
-- মেয়েটা একাকিত্বের জন্য আগের বিষয় গুলো ওকে চেপে বসে। ও মনে মনে একটা ভয় আর ভাবনায় কাটায়, তাই এমন হচ্ছে। আপনারা বাচ্চা নিয়ে নিন।
সব ঠিক হয়ে যাবে।
-- জ্বি ধন্যবাদ।
তারপর থেকে ফারহান মৌমির আপত্তি থাকা সত্বেও কাজের মেয়ে রাখলো। এক সপ্তাহ পরপর বাড়িতে গিয়ে ঘুরে আসতে শুরু করলো। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে মৌমিকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরাঘুরি শুরু করলো। যাতে মৌমিকে বেশি সময় দিয়ে সব ভুলিয়ে দেওয়া যায়।
একসময় শত প্রতিক্ষা আর অপেক্ষার পর তাদের ঘরে ফুটফুটে একটা মেয়ে জন্ম নিলো।
আর আজ দেখতে মেয়েটার বয়স দুই বছর।
মেয়েটাও মৌমির মত, আইসক্রিম আর চকলেটের জন্য পাগল। মায়ের মত চিমটি ও দেয়।
বাবা মা একটু কথা কাটাকাটি করলেও, মাঝখানে এমন কথা বলে, বা এমন আচরন করে যে দুজনকে আবার সব ভুলে ভালো হয়ে যেতে হয়।
প্রতিদিন ই তাদের ঘরে আনন্দ আর হুল্লোড় চলে।
ভালোবাসা তো এমনই, বেচে থাক ভালোবাসা, বেচে থাক তাদের সুন্দর সম্পর্ক।
লেখিকার কথাঃ তাড়াতাড়ি করে শেষ করে দিলাম তাই ভালো নাও হতে পারে। ইনশাআল্লাহ আগামী গল্প আরও সুন্দর করে আপনাদের দেওয়ার চেষ্টা করবো।
❤❤সমাপ্ত❤❤
darun
ReplyDeleteধন্যবাদ আপনাকে
Delete