রিপোর্ট
- মেহজাবিন মুন
অজানার পথে হেঁটে চলেছে মুসকান, হাতে ছোট্ট একটা ব্যাগ এ কিছু কাপড় আর কিছু টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। এগুলোতে ১০/১৫ দিন চলে যাবে, তারপর তো আর কোনকিছুরই প্রয়োজন পড়বে না। বেরিয়েছে বললে ভুল হবে, মুসকান বাড়ি থেকে পালিয়েছে।
আজ রাত পোহালেই মুসকানের বিয়ে, কিন্তু যে মেয়ে দুনিয়াতেই আর কিছুদিনের অতিথি তার আবার বিয়ে! সে চায় না তার সাথে জড়িয়ে একজন মানুষের জীবন নষ্ট হোক, বাড়ির সবাই এটা জেনে আনন্দটা নষ্ট করুক। বিয়ের খুশির বদলে শোকের মাতম হোক বাড়িতে এটা সে সহ্য করতে পারবে না। তারচেয়ে বরং সবাই জানুক মুসকান বিয়ের আগেরদিন রাতে বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়েছে। এই জীবনে নাহয় খারাপ সেজেই সবার মনে থাকলো, অন্তত সবাই ভাববে সে বেঁচে আছে। আজকের বিকালের আগেও মুসকানের মনে ছিল রঙিন স্বপ্ন, সেও একটা সুখের নীড়ের আশা করেছিল, যে নীড়ে সে কপোতী আর তার কপোত হবে রায়ান। একটা ভালোবাসাময় সুখের চাদরে ঢেকে থাকবে তাদের নীড়।
কিন্তু বিকালবেলা যখন তার চেকআপ রিপোর্ট আনতে গেলো, কল্পনাও করতে পারেনি মুসকান যে তার জীবনের চাকাটাই পাল্টে যাবে। না না পাল্টে নি, ব্রেকফেইল করেছে, যেকোন সময় ব্লাস্ট হয়ে যাবে সেই চাকা।
---- ডাক্তার সাহেব আর কতক্ষণ লাগবে? আমার মেয়ের গায়ে হলুদ আজ, মেহমানরা আসা শুরু করেছে। এখন বাড়ি না গেলে তো হবে না।
--- আরও আধাঘন্টা লাগবে ম্যাডাম, আমাদের কিছু করার নেই।
--- ইয়া আল্লাহ! এখন আমি কি করবো? এদিকে যে অনেক কাজ পড়ে আছে।
---- আম্মু তুমি চলে যাও, আধাঘন্টার তো ব্যাপার। আর বাসা পাশেই আছে আমি আসতে পারবো। মুসকান তার মাকে বললো।
মুসকান আর তার মা এসেছেন রিপোর্ট নিতে। কিছুদিন থেকে মুসকানের কোমরে আর তলপেটে ব্যথা করে তাই চেক আপ করানো হয়েছে। আজ মুসকানের রিপোর্ট দেওয়ার কথা, রিপোর্ট ও নেওয়া হলো আর কিছু কেনাকাটাও করা হলো সেই সুবাধে মা মেয়ের আসা।
আধাঘন্টা পর ডাক্তার মুসকানকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি রিপোর্ট টা আপনাকে জানাবো? না আপনার মাকে?
---- আম্মু তো চলে গেছেন আমাকে জানান।
---- আচ্ছা আপনি অনার্স কোন ইয়ারে পড়ছেন?
--- জি, থার্ড ইয়ার, কেন স্যার?
মুসকান ভয়ে ভয়ে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলো।
---- এসময় আপনাকে মন শক্ত রাখতে হবে, যেহেতু রোগটা আপনার, তাই আপনাকে জানানো উচিৎ বলে আমি মনে করছি।
---- বলুন ডাক্তার, আমি শুনতে প্রস্তুত আছি।
---- আপনি অনেক দেরী করে ফেলেছেন, আরও আগে আসা উচিৎ ছিল। আমাদের কিছু করার ও নেই।
---- কি হয়েছে আমার? চিৎকার করে জানতে চাইলো মুসকান।
---- আপনার দুটি কিডনীই ড্যামেজ হয়ে গেছে। বেশি হলে আর ১৫ দিন বাঁচবেন আপনি।
---- না এ হতে পারে না, ডাক্তার আপনি ভুল করছেন, এটা আমার রিপোর্ট না। আপনি আবার চেক করেন।
---- আমাদের ভুল হয়নি,, আমরা রিপোর্টে ভুল করিনা ম্যাম।
---- নাআআআআআ, এ হতে পারে না। আল্লাহ! আমি এখন কি করবো? কি জবাব দেবো সবাইকে? জীবন শুরু হওয়ার আগেই থেমে গেলো?
অনেকক্ষণ সেখানেই বসে কাঁদলো মুসকান।
মুসকানের মা চলে যাওয়ার পর মুসকান রিপোর্ট নেওয়ার জন্য বসে ছিলো। এখন আর বসার মানে নেই, সব শেষ। ভগ্ন হৃদয়ে ডাক্তারকে বললো, আমার একটা অনুরোধ রাখবেন?
--- জি বলুন?
আমার রিপোর্ট টা আর কাউকে জানাবেন না। আপনি ওটা হাইড করে নিন। আমিও ওটা আর দেখতে চাইনা। তারপর ঝড়েরবেগে চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেলো।
বাসায় আসার পর কারও সাথেই কথা বললো না, দরজা লাগিয়ে অনেক্ষণ কাঁদলো, রায়ান তাকে ফোন দিয়ে বললো,
--- আমি আপনাকে না জিজ্ঞেস করেই লালশাড়ি কিনেছি, আমার খুব ইচ্ছা আমার বউ লাল টুকটুকে বউ সাজুক।---- পরে আপনার সাথে কথা বলবো। বলে মুসকান ফোন কেটে দিলো।
তারপর একটা সিদ্ধান্ত নিল, সে পালিয়ে যাবে, হ্যা সে বাড়ি থেকে পালাবে। গভীর রাতে শুরু হলো তার পালিয়ে বাঁচার জীবন, নাহ্ মরন থেকে নয়, জীবন থেকে, জীবনের প্রতিটি অধ্যায়, পৃষ্টা থেকে পালিয়ে বাঁচা।
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই ভাবছে রায়ান যখন তাকে ফার্স্ট দেখতে আসে, খুব সাদাসিধা একজন মানুষ হয়ে এসেছিল। তার দিকে একবারও না তাকিয়ে শুধু বলেছিল
--- আমার বেতন মাত্র পনের হাজার টাকা, ম্যানেজ করতে পারবেন তো সংসারটাকে?
কোন মানুষ কতটা অসাধারণ হলে এভাবে কম বেতনের কথা তুলে ধরে!
-- তিনবেলা ডালভাত খেয়ে দিব্যি সংসার চলে যাবে। মুসকান লাজরাঙা মুখে জবাব দিয়েছিল।
--- না না, মাঝে মাঝে মাছ মাংস খাবো তো, ডালে এলার্জি আছে।
রায়ানের কথা শুনে মুসকান শব্দ করে হেসে দিল, রায়ানও তখন বোকার মতো হাসলো। তখন থেকেই দুজনকে দুজনের ভালো লেগে যায়।
রায়ান হয়তো অনেকবার ফোন দিচ্ছে কিন্তু মুসকান ফোন নিয়ে আসেনি।
---- মা! এতো রাতে এই গায়ের পথে বসে আছো কেন? আজকালকার ছেলেপিলে ভালো না, তুমি যাবে কই?
---- আমি, আমি কই যাবো!! আচ্ছা এটা ঢাকা থেকে কতদূরে? এ জায়গার নাম কি?
--- এটা তো সিলেট মা, তা যাবে কই বললে না তো? পথ হারিয়েছো বুঝি?
--- না মানে হ্যা, এখন আমি যাবো কই বুঝতে পারছি না।
--- চলো আমাদের বাড়ি চলো, ভয় নাই, আমরা বুড়ো বুড়ি তে সংসার। ছেলেমেয়েরা সবাই বাইরে, কোন সমস্যা হবে না। যতদিন বাড়ি না যাচ্ছো, আমার এইখানে থাকবে।
মুসকান মন খারাপ করে বসে আছে, আজ এক সপ্তাহ হয়ে গেলো বাসার খবর জানেনা, রায়ান ও বিয়ে করেছে কিনা জানা হলো না। তারচেয়ে বড় কথা, তার যদি কিডনী সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে থাকে তো তার কোন সমস্যা করে না কেন? সেতো দিব্যি ভালো আছে, শরীর ও দূর্বল লাগছে না। সে মনে করেছে সারাদিন পশ্রাব হবে না, বা বেশি হবে, কিছুই হলো না, বিছানায় ও পড়তে হলো না।
যে অসুখের জন্য বাবা মা আত্মীয় স্বজন, সবাই ছেড়ে দিয়েছি, পালিয়ে এসেছি জীবন থেকে। তার তো কোন আলামতই নেই।
মুসকান রাতের তারাভরা আকাশ দেখছিল আর ভাবছিল। বাবা মা ছেড়ে কখনও থাকেনি সে, আজও বাবা মা কে খুব মনে পড়ছে, মনে পড়ছে রায়ান কে।
চাচাতো বোন রিহাকে একটা ফোন দিয়ে দেখিতো, যেই ভাবা সেই কাজ আশ্রয়দাতা চাচার কাছ থেকে ফোন নিয়ে নাম্বার ডায়াল করলো সে।
--- রিহা.. কেমন আছিস রে তুই?
---- আপু তুই কোথায়? তোর লজ্জা করলো না এভাবে পালিয়ে গেলি? ছি! এটা আমরা আশা করিনি, জানিস চাচা চাচি কতটা মুষড়ে পড়েছে? চাচি তো খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে বিছানা নিয়েছে।
--- আম্মুকে বলিস আমি ভালো আছি, আর রায়ান কি বিয়ে করেছে কোথাও?
--- নাহ, তোর যদি অন্য কোথাও প্রেম ছিল তাহলে বলতেই পারতি, বিয়ের আগের দিন পালিয়ে যাওয়ার কি দরকার ছিল?
---- রায়ানকে বলিস সে যেন অন্য কোথাও বিয়ে করে নেয়, আমার জন্য অপেক্ষা না করে। তারপর কান্না লুকানোর জন্য ফোন কেটে দিলো সে।
আড়াল থেকে বাড়ির মালিক আর তার স্ত্রী সব শুনলেন।
দুইদিন পর উনারা মুসকানের পাশে এসে বসলেন,
--- কি ব্যাপার মা? আমাদের কাছে তুমি কিছু লুকাচ্ছো, নিজের বাবা মা মনে করে বলতে পারো। চাচীআম্মা মুসকানের মাথায় হাত রেখে বললেন। উনার কথায় মুসকানের সব কষ্ট, যন্ত্রণা যেন এক সাথে বাইরে বেরিয়ে আসলো। সে সবকিছু খুলে বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
--- তারপর আমি পালিয়ে যাচ্ছি এরকম একটা চিঠি লিখে চলে আসছি। আমি বাবা মায়ের কষ্ট সহ্য করতে পারবো না চাচীআম্মা আমি পারবো না রায়ানের মতো একজন মানুষের জীবন নষ্ট করতে।
---- কে বললো আমার জীবন নষ্ট হবে? আপনার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আপনার পাশে আছি আমি।
সামনে রায়ানকে দেখে মুসকান চমকে উঠলো।
---- আপনি এখানে কি করে? কে আপনাকে ঠিকানা দিলো?
--- ভুলে গেছেন আজকালকার যুগে সব সম্ভব? সিম রেজিস্টার থেকে ঠিকানা বের করে চলে এসেছি।
---- কিন্তু কেন?
---- আমি আপনাকে প্রথম দেখেই চিনেছি, আপনি কারও সাথে প্রেম করতে পারেন না। সবাই বিশ্বাস করলেও আমি করিনি, তাই রিহার কাছ থেকে ফোন নাম্বার জেনে ঠিকানা বের করে এসেছি।
---- আপনি চলে যান, আমার মতো মৃত্যু পথযাত্রীকে কেন আপনার জীবনে জড়াবেন?
---- আমি আপনার চিকিৎসা করাবো, আপনাকে ভালো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।
----- দেখেন মরা গাছে পানি দিয়ে লাভ নেই, আপনি চলে যান। বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করুন।
এতক্ষণ থেকে চাচা চাচী ওদের কথা শুনছিলেন এবার চাচা বলে উঠলেন,
---- যে ছেলে মৃত্যুর সংবাদ শুনেও পিছপা হয়নি তাকে তুমি ফিরিয়ে দিওনা মা। চলো আমরা সবাই মিলেই ডাক্তারের কাছে যাই।
কিন্তু অবিশ্বাস্য ভাবে ডাক্তার জানালেন মুসকানের কোন অসুখ নেই, সব নরমাল। কোন ডাক্তার এসব বলেছে তিনি রেগেমেগে জানতে চাইলেন।
উনাকে যখন হসপিটাল আর ডাক্তারের নাম বলা হলো ডাক্তার চমকে গেলেন। এতো এমবিবিএস নয় সাধারণ হাতুড়ে ডাক্তার, এই হাসপাতালের কিছু বদনাম শুনেছিলাম আজ হাতেনাতে প্রমান পেয়ে গেলাম।
পরবর্তিতে দেখা গেলো ডাক্তার রিপোর্ট বদল করে ফেলেছেন তাই এক মুসকানের রিপোর্ট অন্য মুসকানের কাছে চলে এসেছে। একটা ভুল রিপোর্ট যে একটা জীবন, সংসার নষ্ট করতে পারে। কিছু মানুষের মুখের হাসি, সুখের মুহুর্ত কেড়ে নিতে পারে, করে দিতে পারে সারাজীবনের জন্য বদনামী। এদের মতো হাতুড়ে ডাক্তার আর অজ্ঞ কর্মীদের কে বুঝাবে?
---- মুসকান আমার চশমা খুঁজে পাচ্ছি না। শার্ট কোনটা পরে অফিসে যাবো?
---- ইশ্ আমি তো রান্নাঘরে, খুঁজে দেখো না। এখন আসলে ভাজি পুড়ে যাবে।
---- যাক পুড়ে, তুমি জানো না, তোমাকে ছাড়া আমি কিছু খুঁজে পাইনা?
---- আমি মরে গেলে তখন কি করবে? একা হাঁটতে শিখো, চলতে শিখো। গামছায় হাত মুছতে মুছতে মুসকান রুমে এসে ঢুকলো।
--- আমি কখনও তোমায় ছাড়া চলতে পারবো না। মুসকানের আঁচলে মুখ মুছে রায়ান জবাব দিলো।
----- তুমি মাত্র বাথরুম থেকে বেরিয়েছো? তারমানে চশমা, শার্ট কিছুই খুঁজোনি?
---- আমার পাগলী বউটা থাকতে আমি কেন খুঁজবো?
রায়ান মুসকানকে জড়িয়ে ধরলো।
মুসকান রাগতে গিয়েও হেসে দিলো।
---- আর আমার রান্নাবান্না কে সামলাবে?
এইতো মা মুসকান রান্না করা আর লাগবে না, আমিই রান্না করে এনেছি।
---- আম্মু তুমি এতো সকালে?
---- তোর বাবার রাত থেকে তোকে দেখতে ইচ্ছা করছে, তাই এতো সকাল আসা।
----- আর তুমি বলোনা কেন, তাহাজ্জুদ এর সময় থেকে উঠে যে রান্না শুরু করেছো? টান কি শুধু আমার?
দুজনের ঝগড়া দেখে মুসকান আর রায়ান হাসতে শুরু করলো।
--মেহজাবিন মুন